ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষের বেশ কয়দিন পার হলেও- এখনো ধোঁয়াশায় ঢেকে আছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর থেকেই উত্তেজনা বাড়ে। এরপর ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে নয়টি লক্ষ্যবস্তুতে ‘সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক অভিযান’ চালায়। পাকিস্তান জবাবে ড্রোন হামলা করে। সংঘর্ষ থেমে গেলেও অনেক অভিযোগ-পাল্টা দাবি, সামরিক অভিযান ও কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে ঘটনা ও সিদ্ধান্তের বিস্তারিত।
পেহেলগাম হামলার পর ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছিল, তারা তিনজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করেছে। এদের মধ্যে একজন কাশ্মীরি, বাকি দুজন পাকিস্তানি। তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। নাম প্রকাশ করা হয় আদিল হুসেন ঠোকার, হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান এবং আলি ভাই ওরফে তালহা ভাইয়ের।
তবে এতদিনেও এই তিনজনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য মেলেনি- তারা আটক, নিহত না পালিয়ে গেছে তা এখনো স্পষ্ট হয়নি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জীবন রাজপুরোহিত বলেন, এই সন্ত্রাসীদের নির্মূল কঠিন কারণ তাদের রয়েছে স্থানীয় সমর্থনের জাল ও পাকিস্তানি সহায়তা। শুধু সন্ত্রাসী নয়, গোটা কাঠামোকে ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

ভারতের অভিযান ও পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় বেসামরিক নাগরিক ও সেনাসদস্যদের হতাহতের খবর মিলেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেছে বিবিসিসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। কিন্তু ভারত সরকার এই পর্যন্ত নিহতদের সংখ্যা বা পরিচয় সম্পর্কে কোনো সরকারি তথ্য প্রকাশ করেনি।
সাবেক এয়ার মার্শাল দীপ্তেন্দু চৌধুরী বলেন, সীমান্তে এমন সংঘর্ষে নির্দিষ্ট ‘স্ট্যান্ডিং অপারেটিং প্রোসিডিউর’ থাকে। প্রতিটি রাজ্যের সীমান্ত এলাকার ঝুঁকির মাত্রা আলাদা। যেহেতু পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে যায়, তাই আগেভাগে বেসামরিকদের সরানোর মতো সময় বা কারণ ছিল না।
তিনি আরো বলেন, সাধারণত যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়লে মানুষকে সরানো হয় কিন্তু এই ঘটনায় তা আগাম বোঝা যায়নি।

জম্মু ও কাশ্মীরের পাম্পোরে পাওয়া ধাতব টুকরো নিয়ে শুরু হয় আরেক বিতর্ক। পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতের একটি রাফাল যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। তবে ভারত সরকার তা নিশ্চিত করেনি বা সরাসরি অস্বীকারও করেনি।
ভারতের পক্ষ থেকে সেনাপ্রধান এয়ার মার্শাল একে ভারতী সাংবাদিকদের বলেন, সব পাইলট নিরাপদে ফিরে এসেছেন। আমরা আমাদের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছি- এটাই আসল।
অন্যদিকে পাকিস্তানের বিমান ধ্বংস করার দাবিতেও ভারত নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকেছে। ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি বলেই সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে গেছে ভারতীয় সামরিক নেতৃত্ব।
সাবেক এয়ার মার্শাল চৌধুরী বলেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি হবে- এটাই বাস্তবতা। তবে প্রশ্ন হলো, আমরা কি কৌশলগত উদ্দেশ্য সফলভাবে অর্জন করেছি?

যুদ্ধবিরতির ঠিক আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। অথচ ভারত বলে, পাকিস্তানের ডিজিএমও (ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস) ভারতের ডিজিএমও-র সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়।
সাবেক কূটনীতিক দিলীপ সিং মনে করেন, সম্ভবত পাকিস্তান প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গিয়েছিল, সেখান থেকে মার্কিন প্রশাসন ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে। ভারত হয়ত বলেছে- আমরা প্রস্তুত, তবে পদক্ষেপ পাকিস্তান থেকে আসতে হবে। ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত ও সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ- এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদকে জানানো হয়নি, কোন আলোচনাও হয়নি।
এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক চন্দ্রচূড় সিং বলেন, ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোতে সেনাবাহিনী সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের নজির নেই। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পর্যন্ত বিরোধীদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ হয়নি।
তিনি আরো বলেন, যারা সামরিক গোয়েন্দা ও কৌশলগত তথ্য জানে, তারাই এসব সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তার স্বার্থেই অভিযান সংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে আনা হয় না।

ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষের পর একাধিক বিতর্ক ও রহস্যজনক দিক রয়ে গেছে- যা এখনও অমীমাংসিত। প্রশ্ন রয়ে গেছে হামলাকারীদের ভাগ্য, বিমান ভূপাতিতের সত্যতা, যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত ভূমিকা এবং সংঘর্ষে হতাহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামরিক লক্ষ্য সফল হলেও নাগরিকদের আস্থা, আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করতে হলে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সময়মতো দিতে হবে। তা না হলে- এ ধরণের সংঘর্ষ পরবর্তী সময়ে আরো জটিলতা তৈরি করতে পারে।