যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ইরানে সামরিক হামলা আমাদের বিশ্বকে আরও অনিরাপদ করে তুলেছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে শুরু হওয়া সংঘাত এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ— যা ঘটেছে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের অনুরোধে— আন্তর্জাতিক কূটনীতি, বৈশ্বিক শৃঙ্খলা ও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের প্রশ্নগুলোকে আবারও গভীরভাবে উত্থাপন করেছে।
ইসরায়েল তাদের পরিচিত কৌশলেই ইরানে হামলা চালিয়েছে, যেখানে লক্ষ্যবস্তু ছিল কেবল সামরিক ঘাঁটি নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের মতো বেসামরিক অবকাঠামোও। এই হামলায় শত শত ইরানি বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এটি স্পষ্ট যে এই আক্রমণ কেবল প্রতিরক্ষা বা প্রতিশোধের জন্য নয়; বরং ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসার পর শুরু হওয়া সংবেদনশীল কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করাই এর মূল উদ্দেশ্য ছিল।
এই হস্তক্ষেপ ট্রাম্পের নিজস্ব প্রতিশ্রুতি— বিদেশে ব্যয়বহুল যুদ্ধ বন্ধের— সম্পূর্ণ বিপরীত। একইসঙ্গে এটি আবারও প্রমাণ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিনির্ধারণে ইসরায়েলের প্রভাব কতটা গভীর এবং নিরঙ্কুশ। যদিও ইসরায়েল বারবার তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ও সামরিক দক্ষতা নিয়ে আত্মগর্ব করে এসেছে, তবুও ইরান সফলভাবে ইসরায়েলের সামরিক টার্গেটগুলোতে আঘাত হানতে পেরেছে এবং একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাতার ঘাঁটি আল-উদেইদেও একটি প্রতীকী হামলা চালিয়েছে— যা ছিল সুস্পষ্ট বার্তা।
এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়োল্লাস দ্রুত ম্লান হয়ে গেছে। কারণ ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের অবস্থান নিয়ে এখন গোপন বিতর্ক শুরু হয়েছে এবং প্রশ্ন উঠেছে যে, সত্যিই কি এই হামলা কার্যকর ছিল। এ অবস্থায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত। ইরান ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, সরাসরি মার্কিন হামলার জবাব তারা দেবে এবং সেইসঙ্গে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার কথা আলোচনায় এসেছে। এমনকি ইসরায়েলের পরমাণু স্থাপনাগুলো— যা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের বাইরে— সেগুলোকেও টার্গেট করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করার চিন্তা শুরু থেকেই অবাস্তব ছিল। যদি ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে এই সংঘাত এক দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধে রূপ নিতে পারে— যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়ের পক্ষেই সামাল দেওয়া কঠিন হবে। ইসরায়েল বহুদিন ধরে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে জ্ঞান মুছে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে, কিন্তু কোনো জাতির পারমাণবিক জ্ঞান বোমা মেরে ধ্বংস করা যায় না।
এই পুরো প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের দোদুল্যমান অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। কখনও তিনি আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, আবার পরের দিনই হামলা চালান, তার পরদিন আবার কূটনৈতিক বার্তা দেন— ফলে ইরান তার প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝে না এবং প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, দু’টি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়তো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইরানের বিরুদ্ধে আগাম হামলা চালিয়েছে— একটি এমন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যার এখনও পরমাণু অস্ত্র নেই। ফলে এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন অনেক রাষ্ট্র এই নজিরকে ব্যবহার করে নিজেদের অস্ত্রায়নের যৌক্তিকতা খুঁজে পাবে। ইসরায়েলের পরমাণু অস্ত্র থাকার ফলে তারা প্রতিরোধ গড়তে পারছে, আর ইরান— যা এখনো সম্পূর্ণ অস্ত্রায়িত হয়নি— কূটনীতি করে কিছুই অর্জন করতে পারছে না। এই বার্তাই এখন অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে।
এর মধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর দুর্বল ও পুনরাবৃত্ত বিবৃতি যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রাসনে মৌন সমর্থনেরই প্রতিফলন। তারা ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’র যে কথা বলে, তার ভিত্তি এমনিতেই ইউক্রেন ও গাজার দ্বিমুখী নীতির কারণে ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেবল তাদের ভণ্ডামিই নয়, বরং তাদের অকার্যকারিতাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যেভাবে ‘শক্তিই ন্যায়’ এই নীতি অনুসরণ করে চলছে, তা কেবল আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও ঐকমত্যকে পদদলিত করছে না, বরং গোটা বিশ্বকে একটি গভীরতর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে— যেখানে কূটনীতি নয়, অস্ত্রই ভবিষ্যতের ভাষা হয়ে উঠছে।