দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে সিরিয়ায় নতুন সরকার গঠনের পর, দেশটি এখন আঞ্চলিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন সিরিয়া কি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে? কারণ, ১৯৪৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, বরং তারা এখনও প্রযুক্তিগতভাবে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে, সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনার মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে উঠে এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম, যারা ২০২০ সালের আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে একের পর এক আরব দেশ—যেমন বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো—ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। ধারণা করা হচ্ছে, সেই ধারাবাহিকতায় এবার সিরিয়াকেও টেনে আনার চেষ্টা চলছে।
২০২৫ সালের মে মাসে ট্রাম্প তিনটি মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন, এবং সৌদি আরবে সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ট্রাম্প তাকে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। তবে বাস্তবতা বলছে, পুরোপুরি স্বাভাবিকীকরণের পথে সিরিয়ার যাওয়া এখনও অনেক দূরের বিষয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গোলান হাইটস ইস্যু এই প্রক্রিয়ার মূল বাধা। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ইসরায়েল গোলান হাইটস দখল করে নেয় এবং তারপর থেকে এই ভূখণ্ডকে নিজের অংশ হিসেবে দাবি করে আসছে। বর্তমানে সেখানে ৩১ হাজারের বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী রয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গিডিওন সাআর স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, কোনো চুক্তির ক্ষেত্রেই তারা গোলান হাইটস ছাড়বে না। এই অবস্থানে সিরিয়ার জনমনে প্রবল আপত্তি রয়েছে।
তবুও, সিরিয়ার অনেক নাগরিক এখন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আলোচনা ও আপোষকেই বেছে নিতে চান। লেখক রবিন ইয়াসিন-কাসাব বলছেন, সিরিয়ারা আজ হতাশ ও ক্লান্ত। তাদের জানা আছে, দেশটি এখন যুদ্ধ করার মতো সক্ষমতা রাখে না। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট আল-শারার আলোচনায় বসা ইতিবাচক বলেই মনে করছেন অনেকে। বাস্তবতা হচ্ছে, এখনকার পরিস্থিতিতে একটি নতুন যুদ্ধবিরতি বা ১৯৭৪ সালের চুক্তির মতো কোনো নিরাপত্তা সমঝোতা হতে পারে সবচেয়ে যৌক্তিক পথ।
এই মুহূর্তে ইসরায়েলও প্রকাশ্যে জানিয়েছে, তারা সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত টম ব্যারাককে এসব আলোচনায় জড়াতে বলছেন। ইসরায়েল জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান তসাচি হানেগবি এই আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, আল-শারা সরকার ইসরায়েলের কাছ থেকে আগ্রাসন বন্ধের প্রতিশ্রুতি চাইছে, তবে তারা এখনও পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি বা কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থান নেয়নি।
এদিকে ইসরায়েল গত বছর সিরিয়ার সীমান্তবর্তী কিছু নতুন এলাকা দখল করেছে। সিরিয়ার পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, একটি নতুন যুদ্ধবিরতির আওতায় তারা এই নতুন দখলকৃত অঞ্চল থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের দাবি তুলবে। যদিও পুরো গোলান হাইটস ফিরে পাওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক দাবি জানানো হয়নি।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—ইসরায়েল চাইছে, সিরিয়ার দক্ষিণ অংশে যেন তুরস্ক, ইরান বা হিজবুল্লাহর মতো শক্তিরা কোনো সামরিক ঘাঁটি স্থাপন না করে। সিরিয়ার প্রতিবেশী দ্রুজ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার অজুহাতে ইসরায়েল সেখানে হস্তক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে, যদিও অনেক দ্রুজ নেতাই ইসরায়েলের এই অবস্থানকে ‘সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সবমিলিয়ে, সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে এক ধরণের যোগাযোগ শুরু হয়েছে—যা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক মোড়। তবে এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সম্পর্কের পথে গড়াবে, না কি শুধুই একটি নতুন যুদ্ধবিরতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ভবিষ্যতের মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিতে এই আলোচনা বড় একটি বাঁক তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যদি যুক্তরাষ্ট্র এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো এতে সমর্থন জানায়।