৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা এবং সাহসী প্রতিশ্রুতি তাঁকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তিনি বলছেন, বিলিয়নিয়ার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিবিদরা মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে তিনি বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুতিগুলো কি শুধুই বাগাড়ম্বর, নাকি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে?
নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বিশ্লেষকদের মতামতের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনে জোহরানের প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলোর সম্ভাব্যতা ও চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ করা হলো-
অভিবাসন নীতি: স্যাংকচুয়ারি শহরের প্রতিশ্রুতি-
উগান্ডায় জন্ম নেওয়া জোহরান নিজে একজন অভিবাসী। তিনি নিউইয়র্ককে আরো শক্তিশালী ‘স্যাংকচুয়ারি সিটি’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, যাতে অভিবাসীরা ভয়মুক্তভাবে পুলিশ বা সরকারি সেবা গ্রহণ করতে পারেন। তিনি অভিবাসীদের জন্য আইনি সহায়তা বাড়ানোর এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সহজ নয়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে স্যাংকচুয়ারি আইনগুলো ফেডারেল সরকারের আক্রমণের মুখে পড়েছিল। ফেডারেল ও স্থানীয় সরকারের মতপার্থক্য এই ইস্যুতে আইনি জটিলতা তৈরি করতে পারে। তবুও জোহরানের এই অবস্থান তাঁর অভিবাসীপন্থী ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে।
শিশুযত্ন: বিনামূল্যের সেবার স্বপ্ন-
নিউইয়র্কে শিশুযত্নের ক্রমবর্ধমান ব্যয় অভিভাবকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জোহরান ছয় সপ্তাহ থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিশুযত্ন এবং নতুন অভিভাবকদের জন্য ‘বেবি বাস্কেট’ (ডায়াপার, শিক্ষামূলক উপকরণ ইত্যাদি) প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া শিশুদের নিরাপত্তার জন্য স্কুলের আশপাশে কিছু সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা এবং সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে টিউশন ফি মওকুফের প্রস্তাব করেছেন।
এই উদ্যোগগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ তহবিল প্রয়োজন। নিউইয়র্কের বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে এমন ব্যয়বহুল কর্মসূচি বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। তহবিল সংগ্রহে উদ্ভাবনী কৌশল এবং রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া এই প্রতিশ্রুতি পূরণে বাধা থাকবে।
পরিবহন: বিনামূল্যে বাস ও কনজেশন প্রাইসিং-
জোহরান নিউইয়র্কের বাস সেবা বিনামূল্যে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০২৩ সালে তিনি গভর্নর ক্যাথি হচুলের সঙ্গে একটি পাইলট প্রকল্পে পাঁচটি বাস রুটে বিনামূল্যে সেবা চালু করেছিলেন, যার ব্যয় ছিল ১২০ মিলিয়ন ডলার। তিনি এখন ৩২৭টি বাস রুটে এই সেবা সম্প্রসারণ করতে চান, যার জন্য বছরে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। তবে মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটি (এমটিএ) বা নগর কর্তৃপক্ষ এই ব্যয় বহন করতে রাজি নয়।
এছাড়া তিনি লোয়ার ম্যানহাটনে ‘কনজেশন প্রাইসিং’ প্রবর্তনের পক্ষে, যা যানজট কমাতে এবং গণপরিবহনের জন্য তহবিল সংগ্রহে সহায়ক। কিন্তু এই নীতি বাস্তবায়নে আইনি ও রাজনৈতিক বাধা রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনা জটিল এবং বাস্তবায়নে সময় লাগতে পারে। জোহরান নিজে গাড়ি ব্যবহার না করে সাবওয়ে বা বাইসাইকেলে চলাফেরা করেন, যা তাঁর পরিবহন নীতির প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
আবাসন: সাশ্রয়ী বাসস্থানের প্রতিশ্রুতি-
নিউইয়র্কের উচ্চ আবাসন ব্যয়কে জোহরান শহর ছাড়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি রেন্ট গাইডলাইনস বোর্ডের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ নিউইয়র্কবাসীর ভাড়া স্থগিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই বোর্ড ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালার স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই বোর্ড স্বাধীন এবং জোহরানের পছন্দের লোক নিয়োগ করে ভাড়া স্থগিত করা রাজনৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বাড়িওয়ালারা এর বিরোধিতা করলে মামলার ঝুঁকি রয়েছে।
তিনি আগামী ১০ বছরে ২ লাখ নতুন সাশ্রয়ী আবাসন ইউনিট নির্মাণ এবং সরকারি আবাসন সংরক্ষণে বর্তমান ব্যয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই বিশাল পরিকল্পনার জন্য প্রচুর অর্থনৈতিক তহবিল প্রয়োজন, যা বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে।
ক্রয়ক্ষমতা: সাশ্রয়ী জীবনযাত্রার পরিকল্পনা-
জোহরানের মতে, নিউইয়র্ক বিশ্বের সেরা শহর হলেও এটি সবার জন্য নয়, কারণ পণ্য ও সেবার দাম তীব্র মূল্য এতটাই যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তিনি প্রতিটি বরোতে সিটি কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন মুদিদোকান চালুর প্রস্তাব করেছেন, যেখানে পাইকারি মূল্যে পণ্য বিক্রি হবে এবং সম্পত্তি কর থেকে রেহাই দেওয়া হবে। এর ফলে পণ্যের দাম কমবে।
কানসাস ও উইসকনসিনে এমন উদ্যোগ সফল হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জটিল। তহবিল সংগ্রহের জন্য জোহরান করপোরেট করহার ৭.২৫% থেকে ১১.৫% বাড়ানো এবং ধনীদের ওপর ২% এককালীন কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন, যা থেকে বছরে ৯০০ কোটি ডলার রাজস্ব আসতে পারে। কিন্তু ২০২১ সালে নিউইয়র্কে ব্যক্তিগত ও করপোরেট কর বাড়ানোর ফলে ধনী ব্যক্তিরা শহর ছাড়তে পারেন, যা রাজস্বের ঝুঁকি তৈরি করবে। রাজ্য আইনসভা ও গভর্নরের অনুমোদন ছাড়া এই পরিকল্পনা কার্যকর করা কঠিন।
বর্তমান ব্যবস্থার জন্য ‘হুমকি’-
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী লেখক ফাহমিদুল হকের মতে, জোহরানের ‘ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট’ অবস্থান তাঁকে বার্নি স্যান্ডার্স ও আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজের মতো প্রগতিশীলদের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তিনি বিলিয়নিয়ারদের প্রভাবের বিরুদ্ধে সাধারণ ভোটারদের কথা শুনেছেন এবং ফ্রি বাস, শিশুযত্ন ও সরকারি মুদিদোকানের মতো ইউরোপীয় ধাঁচের প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলো আমেরিকার জন্য বৈপ্লবিক। তাঁর অভিবাসী, মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় পরিচয় তাঁকে শ্বেতাঙ্গ-খ্রিষ্টান-ইহুদি প্রভাবিত রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে।
ডেমোক্র্যাট দলের পরাজিত প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমো এবং বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নভেম্বরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। ফাহমিদুল হক মনে করেন, জোহরানের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কঠিন নয়; ধনীদের ওপর নিউজার্সির সমান কর বাড়ালেই তা সম্ভব। তবে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট স্ট্যাবলিশমেন্টের বিরোধিতা এবং ইহুদি লবির প্রতিরোধ তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
জোহরান মামদানির প্রতিশ্রুতিগুলো নিউইয়র্কবাসীর জন্য সাশ্রয়ী জীবনযাত্রার স্বপ্ন দেখায়। তবে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক, আইনি ও অর্থনৈতিক বাধা রয়েছে। তাঁর সাফল্য নির্ভর করবে শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন, তহবিল সংগ্রহের কৌশল এবং জটিল প্রক্রিয়া মোকাবিলার সক্ষমতার ওপর। নভেম্বরের নির্বাচন জোহরানের এই স্বপ্নের প্রথম বড় পরীক্ষা হবে।