গত মাসে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধ শেষে আরব উপসাগরীয় দেশগুলো নীরব অবস্থান নিয়েছে। অনেকের কাছে এটি বিস্ময়কর মনে হলেও, কাতারের আল উদাইদে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানঘাঁটিতে ইরানের হামলার পরও এই অবস্থান বজায় থাকে।
যুদ্ধের শেষ দিকে কাতারে ইরানের এই হামলাকে বিশেষজ্ঞরা নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, কাতার উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। যদিও উপসাগরীয় দেশগুলো দ্রুতই নিন্দা জানায়, সেই ক্ষোভ শিরোনাম থেকে দ্রুত হারিয়ে যায়। পরিবর্তে আসতে থাকে এমন সংবাদ যা ইরান ও ওই অঞ্চলের দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলো ইরানের হামলায় কাতারের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে করে। তবে তিনি জানান, আস্থা ফিরিয়ে আনার দায় এখন ইরানের।
সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেক বেশি মিশ্র। ইরানের সঙ্গে একাধিক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক সত্ত্বেও, তারা যুদ্ধের সময় কাতারে হামলার নিন্দা করলেও পরে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দেয়। জুনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ও ইরানি প্রেসিডেন্টের ফোনালাপে যুদ্ধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়।
২০২৩ সালের মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সৌদি চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সৌদি গণমাধ্যমে খুব কম প্রতিবেদন আসে। ধারণা করা হয়, পরিস্থিতির পরিবর্তনে সৌদি আরব পিছিয়ে আসতে পারে।
তবে ২০২৪ সালের শেষ দিকে, ইসরায়েল যখন হেজবুল্লাহ ও সিরিয়ায় অভিযান চালায়, তখন ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব কমে যায়। সেই প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব লেবাননের নতুন নেতৃত্বকে সমর্থন জানায় এবং সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর তেহরান সফর ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। তিনি ইরানের সেনাপ্রধান ও সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, হামলার প্রভাব ইরান-কাতার সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক হলেও তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার আশায় আছেন। দুই দেশের নেতাদের মধ্যে ফোনালাপ হয়, যা সম্পর্ক মেরামতের ইঙ্গিত দেয়।
আল জাজিরা ইরানে ইসরায়েলি হামলাকে উসকানিমূলক বলে বর্ণনা করেছে। তাদের বিশ্লেষকরা বলেন, এই হামলায় ইরানের জনগণের সহানুভূতি সরকারের প্রতি বেড়েছে।
ইসরায়েল ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ইউএই’র জন্য কঠিন হলেও তারা ‘শান্তিপ্রিয়’ নীতি অনুসরণ করছে। প্রেসিডেন্ট বিন জায়েদ ইরানকে সংহতির বার্তা দেন। তবে আল উদাইদ ঘাঁটিতে ইরানি হামলার নিন্দাও করে।
ইউএই কোনো পক্ষ নেয়ার পরিবর্তে পর্দার আড়ালে সংঘর্ষ কমাতে সক্রিয় থেকেছে। তারা ইসরায়েলি আধিপত্য বা ইরানে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।
গাজা যুদ্ধ ও ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আব্রাহাম চুক্তির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। তবু ইউএই ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে সচেষ্ট, যাতে তারা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে।
মার্কিন ঘাঁটি থাকায় কুয়েত সংঘাত নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। তারা ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেছে। যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করায় কুয়েত অন্যদের চেয়ে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে।
ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক মাঝেমধ্যে টালমাটাল হয়ে ওঠে। আরাশ গ্যাস ক্ষেত্র নিয়ে ইরান-কুয়েত বিরোধ এখনো চলমান। এই কারণেও কুয়েত যুদ্ধের সময় অতিরিক্ত সতর্ক ছিল।
ওমান বরাবরই নিরপেক্ষ থেকেছে। তারা ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যেও তারা এই আলোচনা থামায়নি।
আল উদাইদ হামলার নিন্দা করলেও, ওমান ইসরায়েলকে উত্তেজনার জন্য দায়ী করে। তাদের মিডিয়া ইরানকে ‘প্রতিরোধের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরে, আর ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণের সমালোচনা করে।
বাহরাইন ও ইরানের মধ্যে এক দশকের সম্পর্কবিচ্ছেদের পর সম্প্রতি সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আলোচনা চলছিল। এ সময়ই আল উদাইদে হামলা হয়।
সংবাদমাধ্যমে এই হামলা বড় শিরোনাম হয়। “পারস্য উপসাগরের যৌথ ভবিষ্যৎ” নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং ইরানের সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।
ইরান ও ইসরায়েলের যুদ্ধের পর উপসাগরীয় দেশগুলো প্রকাশ্যে নিন্দা জানালেও পর্দার আড়ালে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব কমে যাওয়ায়, এই দেশগুলো কৌশলে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করছে—নিরপেক্ষতা, কৌশলগত সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে।

