চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বুধবার বেজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে এক অভূতপূর্ব সামরিক প্রদর্শনী পরিচালনা করেছেন। এদিন তিনি ঘোষণা করেছেন, “চীন কোনো বুলিদের দ্বারা ভয় পাবে না।” নিক্ষিপ্ত হয়েছে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, রোবট কুকুর, সাবমেরিন এবং পদযাত্রী সৈন্যদের মহাযজ্ঞ। এটি কেবল ঐতিহাসিক উদযাপন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে একটি আভ্যন্তরীণ সতর্কতা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
শি জিনপিং এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যিনি কেবল দেশের স্বার্থই নয়, মিত্রদের স্বার্থ—যেমন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উনের—রক্ষা করতে সক্ষম।
৭০ মিনিটের এই মহাযাত্রায় চীন নতুন এবং আধুনিকীকৃত সামরিক সরঞ্জামের চমক দেখিয়েছে, যা আগে কখনো সাধারণ মানুষের সামনে দেখা যায়নি।
১. আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র

চীনের সামরিক আধুনিকীকরণের মূল ভিত্তি হল পারমাণবিক অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধি। বিশেষভাবে DF-61-এর মতো নতুন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম বলে ধারণা করা হচ্ছে। DF-41-এর ধারাবাহিক এই ক্ষেপণাস্ত্রটি একসাথে ১৪টি ওয়ারহেড বহন করতে পারবে বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
চীনা বিশ্লেষক হাই ঝাও বলছেন, “চীন দেখাচ্ছে যে এটি কেবল আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক স্বার্থ রক্ষায়ও সক্ষম।” যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যা ১,০০০-এর বেশি হতে পারে।
২. অমানবিক সাবমেরিন

এই বছরের সামরিক প্রদর্শনীর আরেকটি আকর্ষণ ছিল নতুন অমানবিক সাবমেরিন। AJX-002 ও HSU-100 নামের এই যন্ত্রগুলো বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি—একটি পানির নিচে মিন স্থাপন করার জন্য, অন্যটি সাধারণ সাবমেরিনের মতো কাজ করবে, কিন্তু ক্রু ছাড়া। বিশ্লেষকরা এটিকে রাশিয়ার Poseidon সাবমেরিনের চীনা সংস্করণ হিসেবে দেখছেন।
এই ধরনের অস্ত্র সামুদ্রিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. লেজার ভিত্তিক বিমান প্রতিরক্ষা

ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে চীনা সেনারা জানে, তাদের বাহিনী ও অবকাঠামোকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করতে হবে। তাই প্রদর্শনীর মঞ্চে LY-1 লেজার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখা গেছে। এটি প্রচলিত সিস্টেমের মতো নয়; বরং শক্তিশালী লেজার বিম ব্যবহার করে আক্রমণকারী লক্ষ্য ধ্বংস করতে সক্ষম।
৪. মধ্য-পরিসরের ক্ষেপণাস্ত্র

DF-29 বা “গুয়াম কিলার” ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যধারিত যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে পরিচিত। এছাড়া HHQ-16C নামের নতুন ক্ষেপণাস্ত্রও প্রদর্শিত হয়েছে, যা চীনের নৌসেনার Type 054 ফ্রিগেট থেকে চালানো যায়। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তাইওয়ানের আশেপাশের যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য।
৫. ড্রোনযুক্ত যুদ্ধবিমান

চীনের হংডু GJ-11 বা “লয়াল উইংম্যান” নামে পরিচিত এই অমানবিক যুদ্ধবিমানগুলো জেএ-২০ বা জেএ-৩৫ ফাইটারের সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম। তারা ভারী অস্ত্র বহন করতে পারে এবং ডেটালিংকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সফল পরীক্ষা হলে, এটি বিশ্বের প্রথম স্টেলথ অমানবিক যুদ্ধবিমান হবে।
৬. রোবট কুকুর

রোবট কুকুর বা “মেকানিক্যাল উলফ” অন্যান্য অমানবিক যন্ত্রের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। চীনা সেনা ভিডিওতে দেখা যায়, এই যন্ত্রগুলো মেশিনগানসহ বিপজ্জনক এলাকায় সৈন্যদের আগে প্রবেশ করে। AI নিয়ন্ত্রণে এগুলো নজরদারি ও লজিস্টিক কাজে ব্যবহার করা যায়। তবে বাস্তব যুদ্ধে এদের কার্যকারিতা এখনও প্রমাণিত নয়।
অস্ট্রেলিয়ার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মিক রায়ান মন্তব্য করেছেন, “প্রদর্শনীতে নতুন প্রযুক্তি দেখানো হয়েছে, কিন্তু তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দক্ষতা নির্দেশ করে না। যেকোনো যুদ্ধের মূল নির্ণয় হলো সৈন্যদের লজিস্টিক ও প্রাকৃতিক প্রস্তুতি।”
পাশাপাশি, রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের মতো উদাহরণ দেখায়, বড় প্রদর্শনী সবসময় বাস্তব সামরিক শক্তি নির্দেশ করে না।
চীনের এই সামরিক প্রদর্শনী শুধুই শক্তির প্রদর্শন নয়—এটি রাজনৈতিক বার্তা, কৌশলগত সতর্কতা এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনার এক মিশ্রণ। তবে বাস্তব যুদ্ধের সক্ষমতা কেবল সরঞ্জাম নয়, বরং সৈন্য, লজিস্টিক এবং কৌশলিক প্রস্তুতির সমন্বয়ে নির্ধারিত হয়।