নেপাল ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হলেও দেশটিতে হঠাৎ শুরু হওয়া সহিংস আন্দোলন এখন দিল্লির জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টানা বিক্ষোভে ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু ও সংসদ ভবনে হামলার পর মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে ব্যাপক সহিংসতায় রূপ নেয়। আন্দোলনকারীরা শুধু সংসদ ভবনেই হামলা চালাননি, কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। ফলে রাজধানী কাঠমান্ডুতে যেন ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কা কিংবা গত বছরের বাংলাদেশের আন্দোলনের দৃশ্যই ফিরে এসেছে।

ভারতের সঙ্গে নেপালের বিশেষ সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো নেপালও ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী, তবে কূটনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কে দেশটির অবস্থান ভিন্ন। নেপালের সঙ্গে ভারতের ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটারেরও বেশি খোলা সীমান্ত রয়েছে। উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, বিহার, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ—এই পাঁচ রাজ্যের মানুষের সঙ্গে নেপালের ঐতিহাসিক যোগাযোগ ও আত্মীয়তার বন্ধন গভীর।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মঙ্গলবার জরুরি বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। পরে এক বার্তায় তিনি লেখেন, “নেপালের সহিংসতা হৃদয়বিদারক। বহু তরুণের প্রাণহানিতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। শান্তি ও স্থিতিশীলতা নেপালের জন্য অত্যন্ত জরুরি।”
কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী
বিশ্লেষকদের মতে, নেপালের অস্থিতিশীলতা ভারতের নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বলেন, “চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড নেপালের ঠিক ওপারে। ইন্দো-গঙ্গা সমতলে পৌঁছানোর রাস্তাও এই দেশ দিয়েই যায়।”
ভারতে অন্তত ৩৫ লাখ নেপালি নাগরিক কাজ করেন বা বসবাস করেন। এর বাইরে আরও অনেকের সংখ্যা অগণিত। নেপালি নাগরিকরা ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই ভারতে যেতে ও কাজ করতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে গুরখা সৈন্যরা ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও কর্মরত আছেন।

ভারতের সঙ্গে নেপালের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। নেপাল তেল ও খাদ্যপণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি মুকতিনাথসহ একাধিক হিন্দু তীর্থস্থান নেপালে অবস্থিত, যেখানে প্রতিবছর হাজারো ভারতীয় ভক্ত যাত্রা করেন।
দিল্লির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ
ওলির পদত্যাগের পর নেপালে কী ধরনের সরকার গঠিত হবে তা এখনও অনিশ্চিত। আন্দোলনকারীরা তিন প্রধান রাজনৈতিক দল—ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল), শের বাহাদুর দেউবার নেপালি কংগ্রেস এবং প্রাক্তন মাওবাদী নেতা প্রচণ্ডর দল—সবকটির বিরুদ্ধেই ক্ষুব্ধ। অথচ দিল্লির সবার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
ভারতের জন্য এখন দ্বৈত চ্যালেঞ্জ। একদিকে নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে, অন্যদিকে প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মের কাছে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাবৃত্তি বাড়ানো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে ভারত তরুণ নেপালিদের কাছে ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে পারে।

প্রতিবেশী কূটনীতিতে ভারতের দুর্বলতা
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থা সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উত্তপ্ত, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে, মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত। এখন নেপালও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় ভারতের চারপাশে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
অশোক মেহতা মনে করেন, “ভারত বড় শক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে ঠিকই, কিন্তু তা অর্জন করতে হলে আগে নিজের প্রতিবেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।”

