মার্কিন বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজার নির্ভরতা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশটির মোট আর্থিক সম্পদের ৪৫ শতাংশ এখন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা রয়েছে। ফলে বাজারের যেকোনো উত্থান-পতনের প্রভাব অর্থনীতিতে বড় আকারে পড়বে।
বর্তমানে মার্কিন অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নমুখী হওয়ায় উদ্বেগ আরও বেড়েছে। ক্রমেই দুর্বল হতে থাকা শ্রমবাজার, শ্লথ ভোক্তা চাহিদা ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যস্ফীতি মার্কিন অর্থনীতির সংবেদনশীলতা বাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের চাঙ্গাভাব অর্থনীতির ইতিবাচক দিক দেখায়। এতে করপোরেট কোম্পানিগুলোর মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ হয়। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীরা বড় রিটার্ন পান। তবে এটি ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ নয়। আর্থিক সম্পদের বড় অংশ শেয়ারবাজারে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় বাজারের উত্থান-পতন অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন। মার্কিন আর্থিক খাতের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ প্রভাবকগুলো স্বাভাবিক আন্তঃসম্পর্কের বাইরে আচরণ করছে। ওয়াল স্ট্রিটের সূচক রেকর্ড উচ্চতায় থাকলেও ডলারের অবমূল্যায়ন এবং স্বর্ণের মূল্য আউন্সপ্রতি ৩৮০০ ডলার ছাড়ানো বিষয়গুলো এই উচ্চতায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর আগে ১৯৩০-এর বৈশ্বিক মহামন্দা এবং ২০০৭-০৮ সালের মন্দার সূচনা পুঁজিবাজারে ধসের মাধ্যমে হয়েছিল। ফেডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট আর্থিক সম্পদের ৪৫ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ একটি মাইলফলক। শেয়ারের উচ্চ দর ও দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি এবং ৪০১(কে) প্ল্যানের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ার ফলে আগের তুলনায় বেশি মানুষ সরাসরি শেয়ারে অংশগ্রহণ করছেন।
এলপিএল ফাইন্যান্সিয়ালের প্রধান অর্থনীতিবিদ জেফরি রশ বলেন, “বিপুল আর্থিক সম্পদ শেয়ারবাজারে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় অর্থনীতির ওপর প্রভাব অনেক বেশি। এখন বাজারের উত্থান বা পতন দুই দিকই সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।” নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট কোম্পানির উত্থান বিনিয়োগকারীদের শেয়ারে আগ্রহ বাড়িয়েছিল। তবে ২০০০-২০০১ সালে অনেক কোম্পানি অতিমূল্যায়িত হওয়ায় বড় পতন শুরু হয়। অর্থনীতিবিদরা এটিকে ‘ডট-কম বাবল’ নামে আখ্যায়িত করেন।
বাজার গবেষণা সংস্থা ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জন হিগিনস বলেন, “এআই-উদ্দীপনা হয়তো বাজারকে কিছু সময় উর্ধ্বমুখী রাখবে। তবে এটি সতর্কবার্তা। আমাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক চলতি বছর ও আগামী বছর বাড়বে। তবে বর্তমান উচ্চ বিনিয়োগ সতর্ক সংকেত।” চলতি বছরের ৮ এপ্রিল থেকে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। বছরের শুরু থেকে সূচকটি ১৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৮ বার সূচক রেকর্ড ভেঙ্গেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার এবং এনভিডিয়ার মতো বড় প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি এই বাজার উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে।
এসঅ্যান্ডপি ডাও জোন্স ইনডিসেসের সিনিয়র বিশ্লেষক হাওয়ার্ড সিলভারব্লাট জানান, ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ প্রযুক্তি কোম্পানি চলতি বছর সূচকের মুনাফার প্রায় ৪১ শতাংশে অবদান রেখেছে। এ কোম্পানি হলো অ্যালফাবেট, অ্যামাজন, অ্যাপল, মেটা, মাইক্রোসফট, এনভিডিয়া ও টেসলা। এখন এই সাত কোম্পানি সূচকের মোট বাজারমূল্যের প্রায় ৩৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে কয়েকটি কোম্পানির ভাগ্য বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
ফেডের তথ্য অনুযায়ী, শুধু মার্কিন পরিবার নয়, বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারে রেকর্ড অংশ ধরে রেখেছেন। নিড ডাভিস রিসার্চের ইউএস সেক্টর স্ট্র্যাটেজিস্ট রব অ্যান্ডারসন বলেন, “শেয়ারের মালিকানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলে মন্দার ঝুঁকি ও ন্যূনতম রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আগামী দশকে গত দশকের মতো বড় রিটার্ন আশা করা উচিত নয়।” যদিও এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক রেকর্ড উচ্চতায়, মার্কিন অর্থনীতিতে বিভাজন ক্রমেই বাড়ছে। ধনী আরও ধনী হচ্ছেন, দরিদ্রদের কষ্ট বাড়ছে। এ কারণে চাকরির বাজারে স্থবিরতা ও মূল্যস্ফীতি বড় ভূমিকা রাখছে।
সিম্পলিফাই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান স্ট্র্যাটেজিস্ট মাইকেল গ্রিন বলেন, “যাদের সম্পদের বড় অংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, তারা ভালো করছেন। অন্যদিকে চাকরিনির্ভররা চাপ অনুভব করছেন।”
জেফরি রশ বলেন, “শেয়ারবাজারের উত্থান ধনীদের নিট সম্পদ বাড়াচ্ছে, তাদের খরচ বাড়ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল করছে। তবে নিম্ন আয়ের মার্কিনরা কষ্টকর অবস্থায় রয়েছেন। বাজারে বড় পতন হলে ধনীদের খরচও কমবে, যা অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।”
চার্লস শওয়াবের সিনিয়র ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট কেভিন গর্ডন বলেন, “বাজারে আর্থিক সম্পদের বড় অংশ থাকার কারণে শেয়ারের ওঠানামা অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘমেয়াদে মন্দা পড়লে পরিবারগুলোর খরচ ও অর্থনৈতিক মনোভাবেও বড় প্রভাব পড়বে।”