স্ট্যানফোর্ডের গবেষণা—
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন শুধু প্রযুক্তির ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারেও বড় পরিবর্তন আনছে। বিশেষ করে তরুণ ও নতুন কর্মীদের জন্য এই পরিবর্তন হয়ে উঠছে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, গত তিন বছরে এআই প্রযুক্তির বিস্তারের কারণে ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সী কর্মীদের চাকরির সুযোগ কমে গেছে। বিশেষ করে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও কাস্টমার সার্ভিসের মতো পেশায় তরুণেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন স্ট্যানফোর্ডের গবেষক এরিক ব্রিনজলফসন, ভারত চন্দর ও রুইউ চেন। তাঁদের প্রতিবেদনে বলা হয়, জেনারেটিভ এআইয়ের প্রসারের পর থেকে যেসব ক্ষেত্র এআই দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত, সেসব খাতে তরুণ কর্মসংস্থানের হার প্রায় ১৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
নতুন প্রযুক্তিতে চাকরি হারাচ্ছে নতুন প্রজন্ম-
স্ট্যানফোর্ড গবেষণায় দেখা যায়, সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সফটওয়্যার উন্নয়ন, কাস্টমার সার্ভিস ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কাজের ওপর। আগে যেসব কাজে নবীন কর্মীদের যুক্ত করা হতো, বর্তমানে সেগুলোর বড় অংশ এখন সম্পন্ন হচ্ছে এআই টুলের মাধ্যমে।
গবেষণাটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থানবিষয়ক সংস্থা এডিপির তথ্য বিশ্লেষণ করে। এতে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে চাকরির সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তরুণ কর্মীদের কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালের শেষ নাগাদ থেমে যায়। উল্লেখযোগ্যভাবে, ঠিক সেই সময়েই বাজারে আসে চ্যাটজিপিটি, যা এআই ব্যবহারের নতুন যুগের সূচনা ঘটায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এআই প্রযুক্তি কাজের গতি ও উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের চাকরির সুযোগ সংকুচিত করছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখন দেখা যাচ্ছে, একদল কর্মীর কাজ কয়েকটি সফটওয়্যারই সম্পন্ন করছে।
ফোর্ড মোটর কোম্পানির প্রধান নির্বাহী জিম ফার্লি এ প্রসঙ্গে বলেন, “ভবিষ্যতে সাদা-পোশাকের অর্ধেক চাকরিই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।”
সামাজিক প্রভাব ও বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ-
এন্টারপ্রাইজ এআই কোম্পানি রাইকের চিফ প্রোডাক্ট অফিসার অ্যালেক্সি কোরোটিচ সতর্ক করে বলেন, “এন্ট্রি লেভেলের পদগুলোর মাধ্যমেই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরি হয়। যদি এআই এই ধাপটিই সরিয়ে দেয়, তাহলে কোম্পানিগুলো একটি পুরো প্রজন্মের নেতৃত্ব হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।”
বর্তমানে বাজারে গিটহাব কোপাইলট, কার্সর, রেপলিট, কোডজিপিটি, বোল্ট ও অ্যামাজন কিউ ডেভেলপারসহ অসংখ্য এআই টুল ব্যবহৃত হচ্ছে সফটওয়্যার উন্নয়নে। পাশাপাশি চ্যাটজিপিটি ও ক্লদ-এর মতো বড় ভাষা মডেল এখন সরাসরি কম্পিউটার কোড লিখতে সক্ষম।
অন্যদিকে কাস্টমার সার্ভিস খাতে ‘এআই সাপোর্ট’ টুলের চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। জনপ্রিয় সফটওয়্যার তুলনামূলক সাইট জি-টু (G2)-এর তথ্যে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে প্রায় ১ হাজার ৮০০ এআই–চালিত সাপোর্ট টুল ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব প্রযুক্তি উৎপাদনশীলতা বাড়ালেও মানুষের হাতে–কলমে শেখার ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আশঙ্কা ও প্রস্তুতি-
বাংলাদেশেও তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর চাকরির প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, ডিজিটাল মার্কেটিং—সব ক্ষেত্রেই এখন এআই ব্যবহারের প্রবণতা স্পষ্ট।
দেশের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে তরুণদের এখন থেকেই নতুন দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হতে হবে। শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয়, সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী চিন্তা ও মানবিক বোধ—এই গুণগুলোই আগামী দিনের চাকরির বাজারে টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।

