মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা এবং যুদ্ধবিরতির জটিলতায় নতুন এক অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। মিসরে আগামীকাল শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের আলোকে গাজা থেকে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। হামাসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সোমবার সকাল থেকে ধাপে ধাপে জিম্মিদের মুক্তি কার্যকর হবে।
গত শুক্রবার গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছেন। এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য গাজার তৎকালীন সংঘাত শেষ করা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানের পথ সুগম করা। ট্রাম্পের নেতৃত্বে মিসরে অনুষ্ঠিত হবে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যেখানে এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের পথ ও পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ হবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের যোদ্ধারা গাজার দক্ষিণাঞ্চল থেকে ইসরায়েলে বড় ধরনের হামলা চালান। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন। এছাড়া হামাস ইসরায়েলি নাগরিকদের জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় ২৫১ জনকে। পাল্টা জবাবে ইসরায়েল গাজায় তাণ্ডব চালায় এবং যুদ্ধের দুই বছরের মধ্যে বেশ কয়েক দফা যুদ্ধবিরতিতে কিছু জিম্মি মুক্তি পায়। তবে এখনও হামাসের কাছে ৪৭ জনের বেশি জিম্মি রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়, যাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন জীবিত।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি-
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে হামাস ও ইসরায়েল একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, সমস্ত ইসরায়েলি জিম্মিকে ধাপে ধাপে মুক্তি দেওয়া হবে। বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে। হামাসের কর্মকর্তা ওসামা হামদান বলেন, “সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, সোমবার সকাল থেকে জিম্মি–বন্দী বিনিময় শুরু হওয়ার কথা।”
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার বিভিন্ন শহর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী ধাপে ধাপে সরে যাবে। সেখানেই মিসর, কাতার, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যৌথ বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে। এই বহুজাতিক বাহিনী পরিচালনা করবে নিরাপত্তা, ত্রাণ ও পুনর্গঠন কার্যক্রম। এছাড়া ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা হবে, যা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি প্রক্রিয়ার সমন্বয় করবে।
সোমবার বিকেলে লোহিত সাগরের তীরবর্তী শার্ম আল-শেখ রিসোর্টে ট্রাম্প ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির যৌথ সভাপতিত্বে শান্তি সম্মেলন শুরু হবে। মিসরের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় জানিয়েছে, ২০টির বেশি দেশের নেতা সম্মেলনে অংশ নেবেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও সম্মেলনে যোগ দেবেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ অংশ নেবেন। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উপস্থিতি নিশ্চিত নয়।
যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির প্রক্রিয়া-
গাজা থেকে জিম্মি মুক্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে হামাস তাদের বন্দীদের বিভিন্ন কারাগারে জড়ো করেছে। জীবিত ও মৃত জিম্মিদের ছাড়াও ২০১৪ সালে জিম্মি করা এক ব্যক্তির দেহাবশেষ ফেরত দেওয়া হবে। ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দী ছাড়বে। এদের মধ্যে কিছু বন্দী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। এছাড়া গাজার ১,৭০০ বাসিন্দাকেও মুক্তি দেওয়া হবে।
শুক্রবার গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে এসেছে। তবে অধিকাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও গাজার পুনর্গঠন, ত্রাণ সরবরাহ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রয়াস ও হামাসের আস্থা-
গাজার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস কয়েক মাস আগে পর্যন্ত ট্রাম্পকে আস্থা না রাখার মতো একটি নেতা মনে করত। তবে গত মাসে একটি ফোনকল পরিস্থিতি পরিবর্তন করে। ফোনকলে হামাসকে বোঝানো হয়, যদি তারা জিম্মিদের মুক্তি দেয়, তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্ভবত ইসরায়েলকে গাজা যুদ্ধ বন্ধে একটি শান্তিচুক্তিতে রাজি করাতে সক্ষম হবেন।
সেপ্টেম্বরে কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলের হামলার পর ট্রাম্প কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে হামলার জন্য ক্ষমা চাওয়ান। হামাস নেতা খলিল আল-হায়াও এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনায় হামাসের মনে ট্রাম্পের সক্ষমতা এবং গাজা যুদ্ধ বন্ধে তার আগ্রহে আস্থা জন্মায়।
দুই ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে হামাস প্রাথমিক ধাপে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফার যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা মেনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, হামাস গাজার ভাগ্য নির্ধারণে ট্রাম্পের ওপর পরবর্তী আস্থা রাখবে।
সম্মেলনে হামাসের অনুপস্থিতি-
হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য হোসাম বাদরান জানিয়েছেন, হামাস সম্মেলনে অংশ নেবে না। মূলত তারা কাতার ও মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তবে হামাসের প্রতিনিধিরা সম্মেলনের বাইরে থেকেই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি-
হামাস নেতারা জানেন, জিম্মি মুক্তির প্রক্রিয়ায় তারা ঝুঁকি নিচ্ছে। মুক্তি দেওয়ার পর ইসরায়েল আবার গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে। তবে দুই বছর ধরে সংঘর্ষ এবং যুদ্ধবিরতির অভিজ্ঞতা থেকে হামাস এই ঝুঁকি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত। অন্য ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা জানান, হামাস বিশ্বাস করছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই চুক্তি ব্যর্থ হতে দেবেন না।
হামাসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অস্ত্র সমর্পণ ও গাজার শাসন থেকে সরে দাঁড়ানো। ট্রাম্পের পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপের বাস্তবায়ন জটিল, কারণ হামাসের অস্ত্রত্যাগ করা সহজ নয়। তবে বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন এবং মধ্যস্থতাকারীদের চাপ যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা-
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার বিভিন্ন শহর থেকে ইসরায়েলি সেনা ধাপে ধাপে সরে যাবে। সেখানে বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন হয়ে নিরাপত্তা এবং পুনর্গঠন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এ ধাপে গাজার জনগণ পুনরায় তাদের বাড়িতে ফিরে আসতে পারবে এবং সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে।
হামাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, এই চুক্তি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি বা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তবে এটি গাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরেও ইসরায়েল গাজার অর্ধেক অঞ্চলে অবস্থান বজায় রাখবে এবং হামাস একটি সংগঠন হিসেবে টিকে থাকবে।
মধ্যস্থতাকারীদের মতো মিসর, কাতার ও তুরস্কও চুক্তি কার্যকর করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল থানি লোহিত সাগরের পাড়ের রিসোর্টে এসে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছেন। তুরস্কের গোয়েন্দা প্রধান ইব্রাহিম কালিনও উপস্থিত ছিলেন। এই উপস্থিতি হামাসের আস্থা জোরদার করেছে।
পরিশেষে, গাজার জিম্মি মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি কার্যক্রম মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের পুনর্বাসন নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি জটিল প্রক্রিয়া যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, মধ্যস্থতাকারী দেশ ও স্থানীয় শক্তি—সবাই সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। যদিও চুক্তি স্বাক্ষরের পরও হামাসের জন্য ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও এটি গাজা যুদ্ধের প্রাথমিক সমাধানের দিকে অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, আল জাজিরা

