মুখে তারা গাজার গণহত্যাকে বলেছে নৃশংস, বর্বর, মানবতার কলঙ্ক। অথচ পর্দার আড়ালে সেই তারাই ইসরাইলকে দিয়েছে সামরিক সহায়তা—হামাসবিরোধী অভিযানে থেকেছে তেল আবিবের পাশে। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক মার্কিন গোপন নথিতে এমনই বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
প্রতিবেদনটি বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের ছয় মুসলিম দেশ—সৌদি আরব, বাহরাইন, মিসর, জর্ডান, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)—গোপনে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোটে। উদ্দেশ্য ছিল ইরানের কথিত হুমকি মোকাবিলা, কিন্তু বাস্তবে এই জোট ইসরাইলের সঙ্গে মিলে কাজ করেছে হামাস ও গাজার প্রতিরোধ শক্তির বিরুদ্ধে।
২০২২ সালে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম)-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় এই জোট। পরে ২০২৪ সালের মধ্যেই ছয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাডার ও সেন্সর নেটওয়ার্কের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। এতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিরোধের নামে ইসরাইলের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার নতুন অধ্যায় শুরু হয়। গোপনে চালানো হয় যৌথ মহড়া, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান এবং সাইবার যুদ্ধ প্রশিক্ষণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই দেশগুলোর সেনারা ইসরাইলি ও মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে টানেল যুদ্ধ মোকাবিলা, আকাশ প্রতিরক্ষা এবং ইলেকট্রনিক নজরদারি প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। আর গাজায় হামলার সময় ইসরাইল ঠিক সেই কৌশলগুলোই ব্যবহার করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
এই সহযোগিতা গোপন থাকলেও, এক সময় প্রকাশ্যে ফেটে পড়ে। গত সেপ্টেম্বরে দোহায় ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হন একাধিক হামাস নেতা। তখন কাতারের ক্ষোভে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিলে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফোনে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে কাতারের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন—ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে এমনই দাবি করা হয়েছে।
তবে এই কূটচাল সত্ত্বেও, আরব নেতারা প্রকাশ্যে গাজার মানুষের পক্ষে আবেগঘন বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে তারা গণমাধ্যমে মানবতার কথা বললেও বাস্তবে যুদ্ধ বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
ওয়াশিংটন পোস্ট ও ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (ICIJ)–এর হাতে আসা মার্কিন গোপন নথিতে দেখা যায়, এই গোপন সামরিক নেটওয়ার্কের মূল উদ্দেশ্য ছিল আঞ্চলিক “স্থিতিশীলতা” বজায় রাখা—যা আসলে ইসরাইলের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলা হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোর কাছে এখন সবচেয়ে বড় ভয় ইরান। ফলে ফিলিস্তিনের রক্ত, ধ্বংস আর শিশুদের আর্তনাদও তাদের নীতি বদলাতে পারেনি। তারা বুঝে গেছে, তেল আবিবের সঙ্গে দূরত্ব মানে ওয়াশিংটনের সঙ্গে দূরত্ব—আর সেটা তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ।
গাজার মানুষ তাই আজও রক্ত ঝরাচ্ছে, কিন্তু আরব বিশ্ব তাদের পাশে নেই—মঞ্চে আছে মানবতার বুলি, আর আড়ালে ইসরাইলের সঙ্গে হাত মেলানোর বাস্তবতা।

