রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে যে জল্পনা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই মিইয়ে গেছে। ট্রাম্প যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি দুই সপ্তাহের মধ্যে বুদাপেস্টে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন, তার অল্প কিছুদিন পরই সেই বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
দুই দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের মধ্যকার প্রাথমিক বৈঠকও বাতিল হয়েছে। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, “আমি এমন কোনো বৈঠক করতে চাই না যা ফলপ্রসূ হবে না। সময় নষ্ট করতে চাই না— দেখি কী হয়।”
এ সম্মেলন স্থগিত হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার সর্বশেষ অধ্যায়। গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন করার পর তিনি এবার ইউক্রেন ইস্যুতে মনোযোগ দেন।
মিশরে যুদ্ধবিরতি চুক্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে ট্রাম্প তার প্রধান কূটনৈতিক উপদেষ্টা স্টিভ উইটকফকে নির্দেশ দেন, “রাশিয়ার বিষয়টা শেষ করতে হবে।”
তবে, গাজায় যে কূটনৈতিক সাফল্য উইটকফ অর্জন করেছিলেন, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তা পুনরাবৃত্তি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ প্রায় চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের জট অনেক গভীর।
ইউক্রেনে সীমিত ট্রাম্পের প্রভাব-
উইটকফের মতে, গাজা চুক্তির মূল চালিকা ছিল ইসরায়েলের হামাস-নিয়ন্ত্রিত মধ্যস্থতাকারীদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত, যা আরব মিত্রদের ক্ষুব্ধ করলেও নেতানিয়াহুকে চাপের মুখে চুক্তিতে রাজি করাতে সহায়তা করে।
ট্রাম্পের ইসরায়েলপ্রীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক তাকে এক্ষেত্রে বাড়তি কূটনৈতিক শক্তি দেয়। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে এই প্রভাব অনেকটাই সীমিত। গত নয় মাস ধরে তিনি কখনো পুতিনকে, কখনো জেলেনস্কিকে চাপ দিলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিনি রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউক্রেনকে দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র দেওয়ার হুমকি দিলেও পরে নিজেই স্বীকার করেন, এমন পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রকাশ্যে জেলেনস্কিকে সমালোচনা করেন, ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদান বন্ধ রাখেন এবং অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করেন— যদিও পরে ইউরোপীয় মিত্রদের চাপে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
পুতিনের কৌশলে ফেঁসে যাচ্ছেন কী ট্রাম্প?
ট্রাম্প বারবার বলেন তিনি “চুক্তি করার ওস্তাদ”, কিন্তু পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে তার বৈঠকগুলো যুদ্ধের কোনো সমাধান আনতে পারেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, পুতিন ট্রাম্পের মধ্যস্থতা-আগ্রহকে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক চাপ লাঘবের কৌশল হিসেবে।
জুলাইয়ে যখন ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছিলেন, তখনই পুতিন আলাস্কায় সম্মেলনের প্রস্তাব দেন— যা পরে স্থগিত হয়। সাম্প্রতিক এক ফোনালাপের পর ট্রাম্প বুদাপেস্টে বৈঠকের ঘোষণা দেন, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই মত পরিবর্তন করেন।
ট্রাম্পের জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকও ফলপ্রসূ হয়নি। বৈঠকের পর তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আমি প্রতারিত হচ্ছি না। আমি জীবনে সেরা লোকদের সঙ্গে কাজ করেছি এবং সবসময় ভালোভাবেই বেরিয়ে এসেছি।”
অন্যদিকে, জেলেনস্কি জানান, ট্রাম্প যখনই ইউক্রেনকে দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র দিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছেন, তখনই রাশিয়া কূটনৈতিক আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
অল্প সময়ের ব্যবধানে ট্রাম্প ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর চিন্তা থেকে পুতিনের সঙ্গে সম্মেলনের পরিকল্পনায় চলে যান এবং পরে জেলেনস্কিকে ডনবাসের একটি অংশ ছেড়ে দিতে চাপ দেন— যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
ট্রাম্প পরবর্তীতে বর্তমান যুদ্ধরেখা ধরে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন, যা রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে “কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন।” কিন্তু এখন তিনি স্বীকার করছেন, যুদ্ধ থামানো তার কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। এটি এক বিরল স্বীকারোক্তি— যেখানে ট্রাম্প নিজের কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও যুদ্ধবিরতির বাস্তব কঠিনতাকে মেনে নিয়েছেন।