সাদা রঙের দেয়াল ঘেরা একটি ছোট হলঘরে ডজনখানেক মা ও স্ত্রী চুপচাপ বসে আছেন সামনের সারিতে। পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা, ভাই ও বন্ধুরা। সবার দৃষ্টি খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের স্ক্রিনে, যেখানে দেখানো হচ্ছে পচে-গেলে যাওয়া মরদেহের ছবি। এসব দেহাবশেষের মধ্যে হয়তো তাদের প্রিয়জনও আছেন।
গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে পরিবারের সদস্যরা এখানে এসেছেন, যাতে তারা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত আত্মীয়দের শনাক্ত করতে পারেন। মরদেহগুলো সম্প্রতি হামাসের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করেছে। তবে এগুলো শনাক্তকরণের কোনো উপায় ছাড়াই ফেরত দেওয়া হয়েছে এবং মৃত্যুর তারিখ বা স্থানও উল্লেখ নেই।
গাজায় ডিএনএ পরীক্ষার সরঞ্জাম না থাকায়, পরিবারের সদস্যদের একমাত্র আশা হলো ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখা। এই প্রক্রিয়া যন্ত্রণামূলক হলেও অন্য কোনো উপায় নেই।

‘চুল থেকে জুতো—সব খুঁটিনাটি দেখি’-
ওয়াফা আল-আলোউল, ৪৫ বছর বয়সী এক নারী, যিনি বর্তমানে চিকিৎসার জন্য মিসরে রয়েছেন, বলছেন, ‘‘আমি মরদেহের প্রতিটি ছবিতে ছেলের চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।’’ তার ছেলে মোহাম্মদ আল-আলোউল গত সেপ্টেম্বরে নিখোঁজ হয়।
ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী হামাসকে এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। অধিকাংশ মরদেহ পচে বিকৃত, কিছু হাত-পা ছাড়া, কিছু হাতকড়া পরা বা চোখ বাঁধা অবস্থায়। তাদের দেহে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার চিহ্ন স্পষ্ট। এখন পর্যন্ত স্বজনদের মাধ্যমে মাত্র ৭৮ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
ওয়াফা বলেন, ‘‘আমি চুল, হাত, উচ্চতা ও জুতো—সব খুঁটিনাটি মনোযোগ দিয়ে দেখি। তারপরও হতাশার মধ্যে ভেঙে পড়ি।’’
‘স্বপ্ন ছিল বুকে জড়িয়ে ধরার’-
ওয়াফার পরিবার গাজার উত্তরাঞ্চলের বেত লাহিয়ায় অবস্থান করেছিল, যেখানে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে তার ছেলে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়। গত এপ্রিলে চিকিৎসার জন্য তাকে মিসরে নেওয়া হয়।
মোহাম্মদ নিখোঁজ হওয়ার আগে পরিবারের জন্য কাঠ ও ত্রিপল খুঁজতে বের হয়েছিল। ওয়াফা বলেন, ‘‘পরিবারের কেউ শেষবারের মতো তাকে সেই দিন দেখেছিল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি এখন শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, অন্তত তাকে কবর দেওয়ার সুযোগ পাই।’’
ওয়াফার মতো গাজার হাজারো পরিবার এখনও তাদের প্রিয়জনের অবস্থান অজানা—নিহত, ধ্বংসস্তূপের নিচে, নাকি ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গুম হয়েছেন।

মরদেহ শনাক্তে ইসরায়েলের বাধা-
গাজার গণহত্যায় আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের হিসাব অনুযায়ী, ২,৭০০ ফিলিস্তিনি এখনও ইসরায়েলের হেফাজতে। গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ৯২ শতাংশ ধ্বংস, আর ফরেনসিক পরিচয়হীন দেহাবশেষ শনাক্তের সরঞ্জাম প্রায় নেই। যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েলের অবরোধের কারণে নতুন ফরেনসিক যন্ত্র প্রবেশ করতে পারছে না, যা মরদেহ শনাক্তের প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
ওয়াফা বলেন, ‘‘আমি মরদেহ শনাক্তকারী দলের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাই। কখনো বন্দীদের তালিকায় ছেলের নাম দেখার আশা করি, আবার কখনো ভয়ে নিহতদের ছবির মধ্যে তাকে খুঁজে পাই কি না ভাবি।’’
গাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে মাত্র কয়েকটি কার্যকর, এবং দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা হামলায় সেখানকার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।

