“একটি বিকট আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কী ঘটেছে বুঝতেই আমাদের ১৫-২০ মিনিট সময় লেগেছিল। সবাই যখন বাইরে আসি তখন বুঝতে পারি থানায় কিছু ঘটেছে”।
শুক্রবার রাতে জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে নওগাম থানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় বার্তা সংস্থা এএনআই-কে এই কথা বলছিলেন সেখানকার বাসিন্দা তারিক আহমেদ।
থানায় বিস্ফোরণে এখনো পর্যন্ত নয়জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৩০ জনেরও বেশি।
পুলিশের সাম্প্রতিক অভিযানে উদ্ধার হওয়া বিস্ফোরক ও রাসায়নিক সামগ্রী ওই থানায় রাখা ছিল। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহের সময়েই বিস্ফোরণ ঘটে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
পরে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিশ্চিত করে।
মন্ত্রণালয়ের জম্মু ও কাশ্মীর বিভাগের যুগ্ম সচিব প্রশান্ত লোখান্ডে “দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা” আখ্যা দিয়ে জানিয়েছেন, সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে হরিয়ানার ফরিদাবাদ থেকে যে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক, দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, সেখান থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর সময় ঘটনাটি ঘটে।
“পর্যাপ্ত সাবধানতা” অবলম্বন করে থানার উন্মুক্ত অংশে রাখা এবং নমুনা সংগ্রহ করা সত্ত্বেও এই ঘটনাটি ঘটেছে, বলেন তিনি।
অন্যদিকে, জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের ডিজি নলিন প্রভাত জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে, ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি টিমের সদস্য, স্টেট ইনভেস্টিগেটিং টিমের সদস্য, ক্রাইম ফটোগ্রাফার, রাজস্ব বিভাগের কর্মী এবং স্থানীয় টেলর রয়েছেন। আহতদের মধ্যে পুলিশকর্মী, রাজস্ব বিভাগের কর্মী এবং বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন। তাদের চিকিৎসা চলছে।

ডিজি নলিন প্রভাত জানিয়েছেন, শুক্রবার রাত ১১টা ২০ নাগাদ হওয়া ওই বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে থানার পাশাপাশি আশপাশের ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বিস্ফোরণের তদন্ত শুরু হয়েছে, তবে এর নেপথ্য অন্য যে কোনো ধরনের তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে জম্মু-কাশ্মীর ও হরিয়ানা পুলিশ যৌথভাবে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছিল। গত নয় ও দশই নভেম্বর হরিয়ানার ফরিদাবাদ থেকে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ দাহ্য ও বিস্ফোরক সামগ্রী ওই থানায় মজুত করা ছিল।
পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, অক্টোবর মাসে নওগাম থানায় দায়ের হওয়া একটি অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায় পুলিশের যৌথ বাহিনী। সেই সময় বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক, দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধার করা হয় বলে বার্তা সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছে পুলিশের কর্মকর্তারা।
অভিযানের সময় বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হয়, যার মধ্যে আল-ফালাহ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপকও রয়েছেন।
এরই মধ্যে গত দশই নভেম্বর দিল্লির লাল কেল্লার কাছে একটি গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। এরপর ঘটনার সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া চিকিৎসকদের যোগসূত্রের বিষয়ে তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শুক্রবার গভীর রাতে হঠাৎ কেঁপে ওঠে শ্রীনগরের নওগাম থানা সংলগ্ন এলাকা। ঘটনার আকস্মিকতায় ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও আওয়াজ শোনা গেছে।
বার্তা সংস্থা এএনআই-কে সেখানকার বাসিন্দা তারিক আহমেদ বলেন, শুক্রবার রাত ১১টা ২২ মিনিট নাগাদ একটি বিকট আওয়াজ শুনতে পান তারা।
“আমরা থানায় দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, চারদিকে ধোঁয়া, মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। এই বিস্ফোরণে মানুষের প্রাণ গেছে। আমাদের বন্ধুদের মৃত্যু হয়েছে, এই পাড়ার বাসিন্দাদের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে” বলেন তিনি।
দ্রুত উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন সিআরপিএফ- এর আইজি পবন কুমার। ঘটনাস্থলটি ঘিরে ফেলার পাশাপাশি যাতে আবার বিস্ফোরণ না হয়, তাও নিশ্চিত করেন কর্মকর্তারা।
জম্মু ও কাশ্মীরের ডিজিপি নলিন প্রভাত ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। এই বিস্ফোরণের তদন্তের কাজও শুরু হয়ে গেছে।

নওগাম থানার বিস্ফোরণ নিয়ে শনিবার প্রথমে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ এবং পরে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়।
ডিজিপি নলিন প্রভাত শনিবার সকালে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “নওগাম থানায় দায়ের হওয়া এফআইআর-এর তদন্তের সময়, নয় ও দশই নভেম্বর ফরিদাবাদ থেকে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক পদার্থ, রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধার করা হয়েছিল। উদ্ধার হওয়া এই সামগ্রীর পাশাপাশি এগুলো নিয়ম মেনেই নওগাম থানার খোলা জায়গায় নিরাপদে এনে রাখা হয়েছিল”।
“নির্ধারিত পদ্ধতির অংশ হিসেবে, উদ্ধার হওয়া সামগ্রীর নমুনা ফরেনসিক এবং রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। যেহেতু উদ্ধার হওয়া সামগ্রীর পরিমাণ বিপুল, তাই গত দুই দিন ধরে এফএসএল (ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি) টিম এই প্রক্রিয়াটি চালাচ্ছিল। গতকাল এবং তার আগেরদিন ধরে এই প্রক্রিয়াটি চলেছে”।
এরইমধ্যে শুক্রবার রাতে বিস্ফোরণটি ঘটে।
ডিজিপি প্রভাত বলেছেন, “উদ্ধার হওয়া সামগ্রী আনস্টেবল এবং সংবেদনশীল হওয়ার কারণে এফএসএল টিম অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই নমুনা সংগ্রহের কাজ করছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রক্রিয়া চলাকালীন গতকাল রাত ১১টা ২০ মিনিট নাগাদ একটি দুর্ঘটনাজনিত বিস্ফোরণ ঘটে”।
ঘটনার পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকার তত্ত্ব খারিজ করেছেন তিনি।
তার কথায়, “এই ঘটনার কারণ সম্পর্কে অন্য কোনো অনুমানের প্রয়োজন নেই। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায়, নয়জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং সংলগ্ন এলাকার ২৭ জন পুলিশ কর্মী, দুইজন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা এবং তিনজন বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছেন। এই বিস্ফোরণে থানা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি আশপাশের বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে”।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব প্রশান্ত লোখান্ডেও শনিবার একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
সেখানে তিনি বলেছেন, “১৪ই নভেম্বর রাতে এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায়, জম্মু ও কাশ্মীরের নওগাম থানায় একটি বিস্ফোরণ ঘটে। নওগাম পুলিশ সম্প্রতি একটি পোস্টারের সূত্র ধরে একটি সন্ত্রাসী মডিউলকে ফাঁস করেছিল”।
“নওগাম পুলিশের এফআইআর অনুযায়ী তদন্তের সময়, বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক এবং রাসায়নিক উদ্ধার করা হয়। থানার খোলা জায়গায় সেগুলো নিরাপদে রাখা হয়েছিল। নির্ধারিত পদ্ধতি মেনে, উদ্ধার হওয়া সামগ্রীর নমুনা রাসায়নিক এবং ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছিল” যে সময় বিস্ফোরণ হয়।
তিনি জানিয়েছেন নোগাম থানায় বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে তদন্ত শুরু হয়েছে। এই ঘটনার নেপথ্যে অন্য কোনোরকম জল্পনা-কল্পনা ‘নিরর্থক’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

থানার কাছেই বসবাসকারী এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, “আমার বাড়ির সবাই নিরাপদে আছেন। তবে আশেপাশের ঘরবাড়ি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।” থানা থেকে তিন নম্বর বাড়িটি ওই ব্যক্তির।
ঘটনাস্থল এখনো ঘিরে রাখা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় ওই এলাকায় উদ্বেগের চাপ স্পষ্ট। শাফাদ আহমেদ নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, “আমার নিকট আত্মীয়দের বাড়ি থানার কাছেই। আমি ওদের সঙ্গে এখনো কথা বলতে পারিনি। আমাদের কেউ যেতে ওদিকে দিচ্ছে না। কী করব? আমি বুঝতে পারছি ওরাও (পুলিশ ও প্রশাসনকে ইঙ্গিত করে) নিরুপায়। আমি আমার জীবনে এত বিকট শব্দ কখনো শুনিনি।”
পুলিশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, হরিয়ানার ফরিদাবাদ থেকে আনা বিস্ফোরক থেকেই এই ঘটনা।
পিটিআই অনুসারে, নওগাম থানায় যে বিস্ফোরক সামগ্রী উদ্ধার করে রাখা হয়েছিল, সেটি ডা. মুজ্জাম্মিল গনির বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত করা ৩৬০ কেজি বিস্ফোরকের অংশ।
দিল্লির লাল কেল্লার কাছে গাড়িতে যে বিস্ফোরণ হয়েছিল, সেই ঘটনায় ডা. মুজ্জাম্মিলের নামও উঠে এসেছে।

বিবিসি হিন্দির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে নওগাম এলাকার বনপুরায় এমন কিছু পোস্টার প্রকাশ্যে আসে যেখানে পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরপর, ১৯শে অক্টোবর শ্রীনগর পুলিশ এই বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করে এবং তদন্তের জন্য একটি পৃথক দলও গঠন করে।
তদন্ত চলাকালীন, পুলিশ প্রাথমিকভাবে তিনজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে, পুলিশ সোপিয়ান থেকে মৌলভি ইরফান আহমেদকে গ্রেফতার করে, যার বিরুদ্ধে পোস্টার সরবরাহের অভিযোগ ছিল।
পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় যৌথ অভিযান শুরু করে।
সেই সময় ডা. মুজ্জাম্মিল গনি এবং ডা. শাহীন সাইদকে গ্রেফতার করা হয়। এরা দু’জনেই ফরিদাবাদের আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত।
তল্লাশির সূত্র ধরে পুলিশ প্রচুর পরিমাণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম নাইট্রেট এবং সালফারের মতো রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধারের তথ্য জানায়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা

