১৯৬৫ সাল। শীতল যুদ্ধের উত্তপ্ত সময়ে চীন তখন প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ একটি গোপন পরিকল্পনা নেয়: হিমালয়ের নন্দা দেবী পর্বতের চূড়ায় একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত অ্যান্টেনা বসানো। কিন্তু সেই অভিযান শেষ হয় অপ্রত্যাশিতভাবে — ব্যবহৃত পারমাণবিক যন্ত্রটি আজও বরফের নিচে নিখোঁজ।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযানে মার্কিন ও ভারতীয় পর্বতারোহীরা অংশ নেন। সঙ্গে ছিল একটি অ্যান্টেনা, ক্যাবল এবং ১৩ কেজি ওজনের জেনারেটর, এসএনএপি-১৯সি। এর ভেতরে প্লুটোনিয়াম ছিল, যা নাগাসাকিতে ব্যবহৃত বোমার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান।
চূড়ান্ত আরোহনের আগে হঠাৎ তীব্র তুষারঝড় নামে। পুরো পর্বত বরফে ঢেকে যায়। তখন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা এম এস কোহলি রেডিওতে জানান, “যন্ত্রপাতি নিরাপদ স্থানে রেখে দ্রুত নামো।” প্রাণ বাঁচাতে পর্বতারোহীরা ক্যাম্প ফোরের কাছে বরফাচ্ছাদিত একটি খাঁজে পারমাণবিক যন্ত্রটি রেখে নেমে যান। এরপর আর তার কোনো খোঁজ মেলে না।
এই গোপন অভিযানের কথা কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি যুক্তরাষ্ট্র। সরকারি ভাষ্য ছিল—“কিছুই ঘটেনি।” অথচ পরিকল্পনার সূত্রপাত হয়েছিল এক ককটেল পার্টিতেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর প্রধান জেনারেল কার্টিস লেমে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের আলোকচিত্রী ও এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী ব্যারি বিশপকে দিয়ে হিমালয়ের কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করান। এরপর সিআইএ বিশপকে ব্যবহার করে একটি ভুয়া বৈজ্ঞানিক অভিযানের আড়ালে গোপন মিশন সাজায়।
ভারতও নীরবে এই অভিযানে যুক্ত হয়, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে। তবে কোহলি শুরু থেকেই সংশয়ী ছিলেন। তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘায় যন্ত্র বসানোর প্রস্তাব ‘অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। শেষ পর্যন্ত নন্দা দেবীকেই বেছে নেওয়া হয়।
সেপ্টেম্বর ১৯৬৫-এ অভিযান শুরু হয়। হেলিকপ্টারে পর্বতারোহীরা উঁচু এলাকায় নামানো হয়। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোহলির ভাষ্য অনুযায়ী, তখন কেউই প্লুটোনিয়ামের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। বরং তেজস্ক্রিয় জ্বালানি থেকে বের হওয়া তাপ শীতের মধ্যে কিছুটা উষ্ণতা দিচ্ছিল।
অক্টোবরের ১৬-তে চূড়ার কাছে ভয়াবহ তুষারঝড় আঘাত হানে। ভারতীয় পর্বতারোহী সোনাম ওয়াংগিয়াল বলেন, “আমরা প্রায় মৃত্যুর মুখে ছিলাম।” শেষ পর্যন্ত যন্ত্র ফেলে রেখে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরের বছর উদ্ধার চেষ্টা হলেও তুষারধসে পুরো এলাকা উধাও হয়ে যায়।
এরপর একাধিক অনুসন্ধান অভিযান চালানো হলেও, বিকিরণ শনাক্তকারী যন্ত্র ও ইনফ্রারেড সেন্সর কাজে আসে না। ১৯৭৮ সালে সাংবাদিক হাওয়ার্ড কোহনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে। ভারতে শুরু হয় বিক্ষোভ। প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়, “সিআইএ আমাদের পানি বিষাক্ত করছে।”
পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই গোপনে যোগাযোগ করেন। প্রকাশ্যে দুই দেশই নীরব থাকে।
আজ অভিযানে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষ প্রয়াত বা বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছেন। নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সের জিম ম্যাকার্থি এখনও বলেন, “গঙ্গার উৎসের কাছে প্লুটোনিয়াম ফেলে রাখা ছিল ভয়াবহ ভুল।” মৃত্যুর আগে কোহলি আফসোস প্রকাশ করেছেন, “সিআইএর পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ অবিবেচনাপূর্ণ।”

