দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে যেসব অঞ্চল সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম মধ্যপ্রাচ্য বা Middle East। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে আজ অবধি মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতিতে বারবার আলোচনা – সমালোচনা হয়েছে। ১৯৪৬ সালে উত্তর ইরান সংকট নিয়ে প্রথম স্নায়ু যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে । অতঃপর ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকট, ইরান -সৌদি আরব ইস্যু । তাছাড়া ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান, ঐতিহাসিক ঘটনা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্য বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুই ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছে । ইরান ও সৌদি আরবের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়নে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়।
সৌদি আরব ও ইরানের বিরোধিতার ইতিহাস দীর্ঘ। সৌদি আরব সুন্নিপন্থী রাষ্ট্র, পক্ষান্তরে ইরান শিয়াপন্থী রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে জাতিগত বিভক্তি। সৌদি আরব এবং ইরানিরা পারস্য জাতি। পারস্য উপসাগর দ্বারা দুই দেশের সীমানা বিভক্ত। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে ১৯২৯ সালে ‘সৌদি – ইরান ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’ স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে। ধর্মীয় মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে ১৯৬০ সালের পর এ সম্পর্ক আর কার্যকর হয়নি । পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে সৌদি বাদশা ফয়সাল ইরান সফর করেন । এই সফরের ফলে সৌদি – ইরান সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি ঘটে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। এজন্য ইরান তখন ওআইসিসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম সংস্থা গঠনে সংহতি জানায়। ১৯৭৯ সালে ইরানের শাহ এর শাসন উচ্ছেদ হয় এবং কট্টরপন্থী শিয়া খোমেনীর নেতৃত্বে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে শুরু হয় সৌদি – ইরানের সম্পর্কের আরেকটি তিক্ত অধ্যায়। শিয়া সুন্নিসহ অন্যান্য দ্বন্দ্বের কারণে ৮০’র দশকে ইরাক – ইরান যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধ সৌদি আরব ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা দেয় এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা দিতে উৎসাহিত করে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে দমন করা। সব নিয়ে সৌদি আরব ইরানের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে । অবশেষ ইরানের পরমাণুর কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাঁধাকে সৌদিআরব সমর্থন জানায়।
ফিলিস্তিন -ইসরাইল ইস্যুতে বিভিন্ন ভাবে এর প্রভাব পড়ছে। সাম্প্রতিক শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরব, ইরান এবং তুরস্ক।সৌদি আরব বলছে তারা ফিলিস্তিন সমস্যার প্রকৃত সমাধান চায়। কিন্তু কখনো কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। পক্ষান্তরে ইরানপন্থী দেশ গুলো সৌদি আরবের অবস্থানকে ইতিবাচক ভাবে নেয়নি। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সৌদি আরব এবং তার সহযোগী দেশগুলোর ধারণা, তারা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে পারবে। অন্যদিকে ইরান গত কয়েক দশক ধরে তার প্রক্সিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে তার অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং সামরিক প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। ইরানের এই কৌশল অনেকটা ফল-প্রশু হয়েছে যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে হামাসকে অস্ত্র সরবরাহ করছে ইরান। তাই সৌদি আরব – ইরান দ্বন্দ্বের কারণে আরব দেশগুলো ফিলিস্তিন ইস্যুতে বরাবরই বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে। মুসলিম দেশগুলো এখন মুসলিম বিশ্ব হিসেবে কাজ না করে স্বতন্ত্র জোট হিসেবে কাজ করছে। ইসলামী জঙ্গি উত্থান ও এই ইরান- সৌদি আরব প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি ফলাফল।
দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলের একটি হলো মধ্যপ্রাচ্য চলতি শতাব্দীর শুরু থেকে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন মেরুকরণ ও অবয়ব করছে এই অঞ্চলে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যে চাঞ্চল্যকর অবস্থা বিরাজমান তার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া অনেকাংশেই দায়ী।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের তার নেওয়া একের পর এক সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হতে থাকে। এ সুযোগ অনেকটা কাজে লাগিয়েছেন রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বিশ্বে রাশিয়ার প্রভাব পূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন।
ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার বৈরিতা রাশিয়ার পক্ষে পুরনো সম্পর্ক পূর্ণ ঘটনা এবং নতুন সম্পর্কে স্থাপনের সুযোগ করে দিচ্ছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ তুরস্ক ও ইরানের সাথে তার সম্পর্ক একটি নতুন গুণগত অবস্থায় এনে দিয়েছে। রাশিয়া এ অঞ্চলের সব দ্বন্দ্ব সংঘাতে সব পক্ষের কাছে নিজেকে মূল্যবান মধ্যস্থতা কারী বা কথোপকথক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্নি আরবরা যে শক্তি জোট গড়ে তুলেছিল, তাই ইরান ও রাশিয়ার সমর্থিত শিয়া মুসলিমদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শক্তি জোটের সাথে নিয়মিত সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ছে ।
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের চিরশত্রু ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অবস্থান যে সৌদি বিপরীত সেই বার্তাই দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাশিয়ার অবস্থানক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে এবং সৌদি আরব এখন এই নতুন শক্তির সাথে এক হতে চাইছে। অন্যদিকে ইরানের সাথে রাশিয়া তার সম্পর্ক বহাল রেখেছে। ২০১৮ সালের যুক্তরাষ্ট্র ইরান পরমাণু শক্তির থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল রাশিয়া তখন তেহরানের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৯ সালে পারস্য উপসাগরে বিভিন্ন তেলবাহী ট্যাংকারে এবং সৌদি আরবের দুটি তেলের প্লান্টে ড্রোন হামলা ঘটনাতে পশ্চিমা বিশ্ব ইরানকে দায়ী করলেও রাশিয়া সে সুরে গলা মেলায়নি। তাছাড়া জাতিসংঘ নিরাপদ পরিষদে মার্কিন সরকার ইরানের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করছে,তার বিরুদ্ধে সরাসরি ভোট দিয়েছে রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সবচেয়ে বড় যে পদক্ষেপ নিয়েছে ইরানের বিরুদ্ধে তা হলো ইরানের সমরনায়ক, শক্তিশালী রিপাবলিকান গার্ডের কুদুস বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করে। যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্য দিয়ে ইরানের ক্ষমতা কাঠামোর অন্যতম প্রতিককে অপসারণ করে। এই পদক্ষেপ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় এলাকায় ইরানের যে প্রভাব বিস্তার হচ্ছে তাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা। সোলাইমানি ছিলেন ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগর এলাকায় ইরানের আধিপত্য বিস্তারের স্ট্রাটেজি নির্মাতা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এবং তার মিত্রদের ধারণা ছিল এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ইরানের শক্তি ক্ষয় হবে এবং ইয়েমেনে হুতিদের মোকাবিলা সৌদি আরব সুবিধা লাভ করবে। ট্রাম্প ভেবেছিল ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কৌশল নির্মাতা এবং ক্রীড়া নায়ক সরিয়ে দিলে ইরানকে দুর্বল করা যাবে এবং মোকাবিলা সহজ হবে, তাছাড়া তেল বিক্রি সহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইরানের দুর্বল অর্থনীতির নিয়েও কোনোভাবে তার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার ধারা বজায় রাখতে পারবে না।এই হত্যাকাণ্ডের পর ইরান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলো এবং তাদের শত্রুদের কড়া জবাব পেতে হবে বলে হুঁশিয়ারি করেছে। কিন্তু ইরান মস্ত বড় ভুলটা করে বসে আর জানুয়ারি ২০২০ ইউক্রেনের উড়োজাহাজ ভূপতিত করার মাধ্যমে। ভুলবশত শত্রুপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ ভেবে সেটি বিধ্বস্ত করলে, এতে গমন কারী ১৭৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিল ইরানি। এ ঘটনায় ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। যাতে ইন্দন দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব।
রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে এবং শান্তি স্থাপনের পরিবর্তে আরব দেশগুলো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয় মিত্র ইসরাইল আরো আগ্রাসী হচ্ছে। নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ভিন্ন নীতির প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতাকারী এবং মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের কাছে নিজেকে নির্ভরশীল বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব এবং ইসরাইলের সহযোগিতা এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে চেষ্টা করছে ।
এক বিংশ শতাব্দীর শুরু হতেই সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করছে। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষাবলম্বন এবং রাশিয়া কর্তৃক ইরানকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া এই সংকটে এনেছে নতুন মাত্রা। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ভিন্ননীতি এবং মিত্রগণ এই অঞ্চলের রাজনীতিতে এনেছে নতুন মোড়। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার পারস্পরিক এ দ্বন্দ্বের ফলাফল কখনোই এদের কারো জন্য ভালো হবে না বলেই প্রতীয়মান হয়।