বিকেলের ম্লান আলোয় আমরা স্কুল মাঠে বসেছিলাম। প্রাইভেট পড়া শেষ করে একটু আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু আমাদের মধ্যে একজন যেন সেই পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল না। সে ঘাসের ওপর ধীরে শুয়ে পড়লো, চোখ দুটি আকাশের দিকে নিবদ্ধ। মনে হচ্ছিল, সে আকাশ দেখছে বটে কিন্তু তার দৃষ্টি আকাশের নীল সীমারেখা পেরিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ করেই সে জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি অংশ আবৃত্তি করল:
“এইখানে ফাল্গুনের ছায়ামাখা ঘাসে শুয়ে আছি; এখন মরণ ভালো, শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস।”
তার কণ্ঠে এক গভীর প্রশান্তি ছিল, যা মুহূর্তের জন্য আমাদেরকে স্তব্ধ করে দিল। কিন্তু সেই প্রশান্তির ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত বিষণ্নতার ছায়া। আমরা সবাই জানতাম, জীবনানন্দ তার প্রিয় কবি, তার কবিতার আবেশেই সে প্রায়শই মগ্ন থাকত। কিন্তু আজকের আবৃত্তিতে ছিল অন্য কিছু—এক ভিন্ন ধরনের বেদনা, যা তার প্রতিদিনের মুগ্ধ কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে গিয়ে আমাদের মনকেও ভারাক্রান্ত করে তুলল।
কবিদের মন বুঝে ওঠা সবসময় কঠিন। তাদের মনোজগৎ এমনভাবে কল্পনার সমুদ্র দিয়ে ঘেরা থাকে যে, তাদের আবেগ ও অনুভূতিগুলোও কল্পনার জালে আবৃত হয়ে থাকে। আজকের বিকেলে, জীবনানন্দের সেই চিরপরিচিত পঙক্তিগুলো যখন তার কণ্ঠে ফুটে উঠল, আমি যেন হঠাৎই সেই ছায়ার ভেতর ঢুকে পড়লাম। তার আবৃত্তি আমার মনে এক অজানা দহন জাগিয়ে দিল, যেন গ্রামবাংলার উনুনে জ্বলতে থাকা আগুনের ওপর পানি ঢেলে দেওয়া হলো। আগুন যেমন সেই মুহূর্তে ফ্যাত করে নিভে যায়, আমার মনের ভেতরের আনন্দও ঠিক তেমন করেই নিভে গেল।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সে আবার কথা বলতে শুরু করল। তার কণ্ঠে ছিল এক গভীর শূন্যতা।
“যদিও সভ্যতার সাথে সাথে আমিও একদিন ধ্বংস হয়ে যাব—এটা নিশ্চিত, তবু সভ্যতা যতক্ষণ বেঁচে থাকে, যতদিন তার জীবিত থাকার ক্ষমতা থাকে, আমিও তার সাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হলো কই? চলে যাচ্ছি তার আগেই, যেতে হচ্ছে, যেতে হবে। হয়তো তোমাদের কারণে, অথবা নিজের।”
তার এই কথাগুলো আমাকে হতবাক করে দিল। তার বক্তব্যে ছিল এক নিঃসঙ্গতার সুর, যেন সে পৃথিবীর সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সভ্যতার সাথে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও, তার মনে হচ্ছিল, সেই সভ্যতার সাথে তার আর কোনো যোগ নেই। সে যেন সময়ের আগে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমাদের কাছ থেকে, পৃথিবীর কাছ থেকে।
আমরা তখন চুপ করে তার কথাগুলো শুনছিলাম, কী বলবো তা বুঝতে পারছিলাম না। তার কণ্ঠে যে বেদনা, সেই বেদনার গভীরতা মাপার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। আজকের বিকেলটি আমাদের কাছে কেবল এক সাধারণ আড্ডার বিকেল ছিল না। এটা ছিল এমন এক সন্ধিক্ষণ, যেখানে জীবন ও মৃত্যুর দ্বন্দ্ব, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আর বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি—সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
তার কবিতা আর কথার মধ্যে এক ধরনের অমোঘ মিল ছিল। হয়তো কবিরা সবসময়ই এমন হয়, তারা তাদের জীবনকেও একধরনের কবিতার ছন্দে বেঁধে ফেলতে চান। কিন্তু আজকের সেই মুহূর্তে, আমি বুঝতে পারছিলাম, সে কেবল কবিতা বলছে না, সে তার নিজের অন্তরের কথা বলছে।