বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো রুশ-অটোমান সম্পর্ক। বিশেষভাবে ১৮-২০ শতকের মধ্যে রাশিয়া এবং ওসমানীয় খিলাফতের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রুশ সাম্রাজ্য ওসমানীয় খিলাফতকে কেন দখল করতে চেয়েছিল। তার পেছনে ছিল একাধিক কারণ। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা, সাম্রাজ্যবাদের প্রসার, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব এবং প্রাক-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আন্তর্জাতিক রাজনীতি।
এই লেখায় আমরা বিশ্লেষণ করব কেন রাশিয়া ওসমানীয় খিলাফত দখল করতে চেয়েছিল এবং সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কী কী শক্তি কাজ করছিল।
সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ও আঞ্চলিক আধিপত্য-
রাশিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্য উভয়ই তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে চেয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাশিয়া, যা ইতিমধ্যে পূর্ব ইউরোপ, ককেশাস এবং মধ্য এশিয়ার বিশাল অংশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। পাশাপাশি আরো শক্তিশালী হতে চেয়েছিল। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল দক্ষিণে অটোমান সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডে প্রভাব বিস্তার। বিশেষত, ককেশাস এবং ব্ল্যাক সি (কালো সাগর) অঞ্চলের ওপর আধিপত্য রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এই অঞ্চলগুলো ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অটোমান সাম্রাজ্য তখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং তা তার প্রভাব হারাচ্ছিল। রাশিয়া, যা তৎকালীন সময়ে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তারা সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে চেয়েছিল। রাশিয়ার জন্য দক্ষিণে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও অটোমান ভূখণ্ড দখল করা একটি প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য ছিল।
অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতা-
অটোমান খিলাফত ১৮ শতকের শেষের দিকে দুর্বল হতে শুরু করে। ১৮১২ সালের পরে বিশেষত, অটোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং সামরিক দুর্বলতা রাশিয়ার জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে। অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি তখন আগের মতো ছিল না এবং পশ্চিমে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে তুরস্কের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এটি রাশিয়াকে অটোমান ভূমিতে প্রবেশ করার জন্য একটি মোক্ষম সুযোগ দেয়।
১৮৫৩-১৮৫৬ সালের ক্রিমিয়ান যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য এক বড় রাজনৈতিক মাইলফলক ছিল। যেখানে রাশিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্য পরস্পর শত্রু ছিল। যদিও যুদ্ধটি রাশিয়ার পরাজয়ে শেষ হয়। তবুও এটি অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতা প্রকাশ করে এবং রাশিয়া ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর পাথওয়া তৈরি করে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-
রাশিয়ার জন্য অটোমান সাম্রাজ্যের মুসলিম শাসন ছিল একটি আরেকটি প্রধান উদ্বেগের কারণ। রাশিয়ান প্রোটেস্টান্ট ও অটোমান মুসলিম শাসনের মধ্যে একটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পার্থক্য ছিল। রাশিয়ায়, বিশেষত রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মধ্যে অটোমান শাসনের প্রতি এক ধরনের ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের মুসলিম শাসনকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা রুশ খ্রিস্টানদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল।
এছাড়াও, রাশিয়া ইসলামিক বিশ্বের ওপর একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব দেখিয়েছিল। যেখানে তারা ইসলামিক শাসনের পরিবর্তে খ্রিস্টান শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা শুধু রাজনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভবান হতে চায়নি বরং ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করেছিল।
বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব-
১৮ শতকের শেষের দিকে বিশ্ব রাজনীতি অনেক পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। ইউরোপীয় শক্তিগুলি একে অপরকে পরাজিত করতে, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। রাশিয়া তখন নিজেকে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিল এবং তার সীমানা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছিল।
রাশিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্য উভয়ই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছিল। এটি শুধু আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ছিল না বরং একটি বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে ইউরোপীয় শক্তিগুলি একে অপরকে প্রতিযোগিতায় হারাতে চাইছিল। রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যকে দখল করার মাধ্যমে বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে চেয়েছিল।
ব্ল্যাক সি (কালো সাগরের) প্রাধান্য-
ব্ল্যাক সি, যা রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। এসব অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। রাশিয়া এই সমুদ্রপথের ওপর পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কারণ এটি তাদের বাণিজ্য এবং সামরিক নৌবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ব্ল্যাক সি অঞ্চলের ওপর দখল এবং নিয়ন্ত্রণ অর্জন রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে, রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। কারণ এটি তাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রবাহ এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলির সাথে সম্পর্কিত বাণিজ্য ও সামরিক কার্যক্রমের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতন: একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ-
অটোমান সাম্রাজ্য ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করলে রাশিয়া মনে করেছিল যে এটি একটি মহতী সুযোগ। ১৮৭০-এর দশক থেকে ১৯০০-এর দশক পর্যন্ত, অটোমান সাম্রাজ্য সারা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কার্যত অক্ষম হয়ে পড়ে। এর ফলে, অটোমান সাম্রাজ্যের অনেক অংশই বিদেশি শক্তির দ্বারা দখল হতে শুরু করে এবং রাশিয়া তাদের সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং তার দুর্বলতার সময়, রাশিয়া এই সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডে প্রভাব বিস্তার করার জন্য প্রস্তুত ছিল। এটি ছিল এক ধরণের সাম্রাজ্যবাদী কৌশল, যেখানে রাশিয়া শুধু নিজেকে এক সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই নয়। বরং অটোমান ভূখণ্ড দখল করে তাদের পূর্ব ইউরোপীয় শাসন প্রসারিত করতে চেয়েছিল।
রুশরা ওসমানীয় খিলাফত দখল করতে চেয়েছিল এমন একটি বহুমুখী কৌশলগত, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কারণে। রাশিয়া যখন তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে চেয়েছিল, তখন তার লক্ষ্য ছিল দক্ষিণে অটোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করা এবং ব্ল্যাক সি অঞ্চলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সামরিক শক্তি এবং ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা মিশে গিয়েছিল, যার ফলে রাশিয়া ওসমানীয় সাম্রাজ্য দখল করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ইতিহাসের এই দৃষ্টিকোণটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে সাম্রাজ্যবাদ, রাজনৈতিক আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা কীভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করে এবং কখনও কখনও এক সাম্রাজ্যের পতন অন্যের উত্থানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।