বাংলাদেশে দেখা গেল কিছুটা গোলাপি রঙের একটি হস্তীশাবক। ১৩ জুন রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় একদল হাতির পানিতে সাঁতরানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরে আসে। হাতির ওই দলে গোলাপি রঙের শাবকটি দেখে চমকে উঠি! এমন হাতি বাংলাদেশে আগে কখনো দেখিনি। হাতির শাবকটি নিজের চোখে দেখার ইচ্ছা জাগে। ১৫ জুন রাতে বন্য প্রাণী গবেষক আমীর হামজাকে নিয়ে রওনা হই রাঙামাটির উদ্দেশে।
পরদিন সকাল ৯টার দিকে আমরা পৌঁছে যাই হাতির নিকটবর্তী এলাকায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বর্তমান ও সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং মাঠপর্যায়ের বনকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতায় হাতির দলটিকে একটি টিলায় খুঁজে পাই খুব সহজেই। শাবকটি দেখে শরীরে শিহরণ বয়ে যায়! এত সহজে হাতির দলটিকে পেয়ে যাব, ভাবিনি।
দলে মোট আটটি হাতি আছে। এর মধ্যে পাঁচটি পূর্ণ বয়সী, একটি কিশোর, দুটি শাবক। সবচেয়ে ছোট শাবকটি গোলাপি রঙের। সাধারণত বাচ্চা হাতির সারা গায়ে কালো লোম থাকে, ফলে বাচ্চার গায়ের রং বেশ কালচে দেখায়। কিন্তু এই শাবক বেশ ব্যতিক্রম। শাবকটির বয়স হবে এক থেকে দেড় মাস। এটি পুরুষ। আমার জানামতে, বাংলাদেশে এর আগে এমন রঙের হাতির দেখা পাওয়া যায়নি।
বুনো কিংবা পোষা প্রাণীর মধ্যে অনেক সময় স্বাভাবিক গায়ের রং থেকে আলাদা সাদা রঙের প্রাণী দেখা যায়। এদেরকে আমরা বলি ‘অ্যালবিনো’। তবে হাতির ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাদা অ্যালবিনো অত্যন্ত বিরল। হাতির ক্ষেত্রে আংশিক রং পরিবর্তন দেখা যায় বেশি। লালচে-বাদামি কিছু হাতি আছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনামে। পানিতে ভিজলে এই রঙের হাতিকে হালকা গোলাপি মনে হয়। এমন হাতি সাধারণত পালা হাতির বংশদের মধ্যে বেশি জন্মগ্রহণ করে।

হাতির দেহের রং কেন সাদা বা গোলাপি হয়, তার গবেষণাভিত্তিক তথ্য তেমন একটা নেই। অনেকে মনে করেন, ত্বকের জন্য দরকারি মেলানিন নামের রঞ্জক তৈরি না হলে বা নষ্ট হয়ে গেলে হাতির দেহের রং এমন হতে পারে। রাঙামাটির এই হাতির শাবকের মা স্বাভাবিক রঙের, তবে দলনেত্রীর শুঁড় ও মাথার সম্মুখভাগ স্বাভাবিকের তুলনায় গোলাপি।
থাইল্যান্ডকে বলা হয় সাদা হাতির দেশ। থাই অধিবাসীরা এই সাদা হাতিকে বিশুদ্ধতা বা পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এ ছাড়া সাদা হাতিকে ভাগ্যের জন্য শুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতীতে ওই দেশে রাজকীয়ভাবে সাদা হাতি পালন করা হতো। প্রথাটি এখনো চলমান, তবে আগের মতো জৌলুশ নেই।
সাদা হাতি নিয়ে আছে নানা রকম মিথ ও পৌরাণিক কাহিনি। এশিয়ার অনেক দেশ, যেমন থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে সাদা হাতিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। অতীতে এই অঞ্চলের রাজা-বাদশাহদের দেশ শাসনের দক্ষতাকে বিচার করা হতো কোন রাজার কতটি সাদা হাতি আছে, সেই সংখ্যা দিয়ে।
রাঙামাটির এই হাতির দলটি তীব্র খাবারের সংকটে পড়েছে। চারপাশে লেকের পানি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু আবাদি টিলা আছে। এসব টিলার অধিকাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন, যেগুলোতে লিচু, আম, আমলকী, কাঁঠালের বাগান করা হয়েছে। এখন ফলের মৌসুমও শেষের দিকে। আশপাশে বন বিভাগের অধীন তেমন কোনো বনভূমিও নেই। ফলে মানুষের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই মুহূর্তে আবাসস্থল পুনরুদ্ধার করার কোনো সুযোগও নেই। শাবকের কারণে হাতির দলটি খুব বেশি চলাচল করছে না। কাপ্তাই লেকের পানি আরও বেড়ে গেলে এবং ওই এলাকায় হাতির দল আরও কিছুদিন অবস্থান করলে আপৎকালীন খাদ্যসংকট মেটাতে বাইরে থেকে কলাগাছ, বাঁশ, লতাপাতা সরবরাহ করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হতে পারে।
এমএ আজিজ: বন্য প্রাণী গবেষক ও অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র: প্রথম আলো