বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ ঘটনা। বাংলাদেশে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের আগমুহূর্তে অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে সূচিত হয়েছে স্বপ্নের এক নতুন অভিযাত্রা। ১৯৭১ সালের পর এত প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি আর কখনো হয়নি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের বুক পেতে গুলি খাওয়ার দৃশ্য যেমন মানুষের চোখে জল এনেছে, তেমনই তাদের অনুপ্রাণিত করেছে সর্বাত্মক আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য। সকল অন্যায়- জুলুম ও বৈষম্য দূর করে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে এ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলো। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দেশে-বিদেশে একজন খ্যাতিমান মানুষ। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় উপদেষ্টা পরিষদে কয়েকজন মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিও আছেন। অন্তবর্তীকালীন সরকারের আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় তারা বেশ সহায়ক হবেন বলে দেশে জনগণ আশা করছেন।
এই ধরনের সরকার গঠন হয় সাধারণত নির্বাচনকালীন সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে । তবে, রাজনৈতিক দায়িত্ব ছাড়াও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা। কারণ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে—বৈশ্বিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি এবং কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে লড়াই করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অর্থনৈতিক সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকটের বর্তমান প্রেক্ষাপট-
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত কয়েক বছরে একাধিক চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের বিঘ্নের কারণে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে পথ বদলেছে। যার ফলে জ্বালানি সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশটির মুদ্রা রিজার্ভে চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষত, মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় সাধারণ মানুষের জীবিকা কঠিন হয়ে উঠছে। শ্রমবাজারে অসামঞ্জস্য, আয় বৈষম্য এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বলতা স্পষ্টভাবে ভেসে উঠে ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এই সংকট মোকাবেলার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে শক্তিশালী মুদ্রানীতি, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া এবং উৎপাদনশীল খাতকে উন্নত করার মতো পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রধান চ্যালেঞ্জ-
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো যথাযথ আর্থিক নীতি গ্রহণ করা। কেননা দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি বর্তমানে চরমে।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে তারা সাধারণত অপারগ। তবে, স্বল্পমেয়াদে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা আরও শক্তিশালী করা- যাতে সুদের হার, বিনিয়োগ এবং মুদ্রা সরবরাহ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। দেখা যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর ওপর মানুষের আস্থা কমছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের কারণে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখার সুযোগ আছে।
এ সমস্যাগুলো সমাধানে দেশের শিল্প কারখানা এবং কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া মানুষের মধ্যে কাজের প্রতি আস্থা এবং উৎসাহ পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন কেননা গত দুই বছরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে তেমন কোনো সুখবর পাওয়া যায়নি। ফলে মানুষ অর্থনীতির কোনো খাতে উন্নতি নিয়ে সন্ধিহান ছিল। তবে কৃষি খাত এর ব্যতিক্রম ছিল। ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটাই বজায় ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের কারণে অন্যান্য কৃষিপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে, যার ফলে বাজারে সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি এবং পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তাই এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ হিসেবে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এখানে বাজার সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে রাসায়নিক সারের অভাব রয়েছে এবং ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানিতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের সার কারখানাগুলো পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ সকল সমস্যাও দ্রুত সমাধান করা অত্যাবশ্যক।
অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মুদ্রার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট ব্যয়ের দিকে আরও মনোযোগী হওয়া জরুরি। বিশেষত, অতিরিক্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারকে মিতব্যয়ী হতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমাতে হবে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে পূর্ববর্তী সরকার বিশাল ঘাটতিসহ বাজেট গ্রহণ এবং অপ্রয়োজনীয় বিদেশি ঋণ নিয়েই দেশের অর্থনীতিতে ও রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করেছিল।
সংস্কারের সুযোগ-
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদিও সময়ের দিক থেকে সীমিত, তাদের কাছে অর্থনৈতিক সংস্কারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের অভিযান হওয়া উচিত দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভিত্তি স্থাপনের। উদাহরণস্বরূপ, সরকার স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করবে। এ ছাড়া, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়ানো জরুরি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য অর্থ সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুঁজে বের করতে পারে। এর পাশাপাশি, ট্যাক্স আদায় পদ্ধতির সংস্কার এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানি হ্রাস করে দেশের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করা যেতে পারে। সরকারি ব্যয়ের গঠনমূলক ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্ব আদায়ের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি-
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এমন একটি অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল এবং উন্নয়নমূলক হবে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক চাপে প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বপ্নময় যাত্রা শুরু হয় দেশের সকল অন্যায় ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী নিয়মনীতিকে সরিয়ে দেশের ভবিষ্যতের জন্য স্থিতিশীলতার ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে। অর্থনৈতিক সংস্কার, আয় বৈষম্য দূরীকরণ এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপই তাদের এ কার্যক্রমকে সফলতা দেবে। অন্তবর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে এ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জকে সামনে আনলেও একথা সন্ধিহানভাবে বলা যায় যে তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সময়ের সীমাবদ্ধতা। তবে যদি সঠিক পরিকল্পনা এবং যথাযথ সহযোগিতার মাধ্যমে সরকার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, তাহলে বর্তমান আর্থিক সংকটের প্রেক্ষাপটে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা বাংলাদেশের জন্য আশার আলো দেখাতে পারে।
একটি নির্দিষ্ট বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন থেকে পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে দেশের মানুষ কি পরিমান সংগ্রাম করেছে ও স্বপ্ন দেখেছে তা অচিন্তনীয়। এর ফসলই হলো পূর্ববর্তী সরকারের বিদায় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমন, যে সরকার পৃথিবীর খুব কম দেশেই রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ, যারা পূর্ববর্তী সরকারের সময় গণআন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে তারা এই সরকারের কাছ থেকে নতুন আশার আলো দেখে। যদিও একাজ অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কঠিন তবুও এজন্য তাদের সে যথাযথ চেষ্টা করে যেতে হবে। সংকট ও অনিশ্চয়তার দিনগুলো পেছনে ফেলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানুষের মাঝে সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্নকে ধীরে ধীরে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছে। এখন আমাদের সামনে সেই সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে, যেখানে জনগণের স্বপ্ন এবং দেশের অগ্রগতি এক নতুন গন্তব্যে পৌঁছানোর অপেক্ষায়। বাংলাদেশের মানুষ এখন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের আশা ও বিশ্বাস রেখে একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের অপেক্ষায় রয়েছে।
লেখক- কাজি মোঃ বদরুদ্দোজা হেলাল