সেদিন বাজারে গেলাম। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ক্রেতা বিক্রেতাকে হুমকি দিয়ে বললেন, ‘তাইলে কিন্তু ছাত্রদের ডাকব।’ বিক্রেতা চুপ হয়ে গেলেন। মনে হলো, কিছুটা ভয় পেয়েছেন।
প্রতিদিন নানা রকম ঘটনা ঘটছে। ঘটনার যেন শেষ নেই। সামাজিক মাধ্যমে চলছে ঘটনাগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে লড়াই। তবে জনগণের মধ্যে সামনাসামনি বাহাস কমই হচ্ছে। কারণ সবাই অদ্ভুত ভয়ে রয়েছে। ভয়ের সংস্কৃতি যেন আমরা কিছুতেই অতিক্রম করতে পারছি না। আগে ভয় ছিল এক রকম; এখন অন্য ধরনের। কিছু ভয় আবার একেবারে নতুন; যেমন মবের দৌরাত্ম্য।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ দেশে ভিন্ন ধরনের কর্তৃত্ববাদের চর্চা হচ্ছে। মব নিয়ে হইচই করে সচিবালয়ে ঢুকে এইচএসসি পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে অটো পাস দাবি; সেই দাবি মেনে পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর একই কায়দায় তা পুনর্মূল্যায়নের দাবি।
বিচারপতি অপসারণে হাইকোর্টে বিক্ষোভ; রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে বঙ্গভবনে বিক্ষোভ। একজন নাট্যব্যক্তির ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে; শিল্পকলায় মব নিয়ে গিয়ে নাটক বন্ধ। মব নিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ। মব চেয়েছে, তাই চট্টগ্রামে লাইফস্টাইল শোরুম উদ্বোধনে যেতে পারবেন না অভিনেত্রী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে আলটিমেটাম।
এর আগে দেখা গেছে মব নিয়ে গিয়ে পদত্যাগ করানোর হিড়িক। মারধর, গণপিটুনি- সবই হচ্ছে। বিবিসির সূত্রমতে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেই গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৪৯ জন।
গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল সবার অংশগ্রহণে। গণআকাঙ্ক্ষায় ছিল বাক্স্বাধীনতা, সমতা, ন্যায্যতা, বৈষম্যহীনতা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর সেগুলো অর্জনের বিপরীতে দেখা যাচ্ছে ‘মবোক্রেসি’।
আরও অবাক করার বিষয়, গণঅভ্যুত্থানের পর যাদের দায়িত্ব ছিল দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সেই গণআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া; তাদেরই কেউ কেউ ‘মব ট্রায়াল’ নিয়ে উস্কানি বা নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
কেন এগুলো হচ্ছে এবং জোরালো প্রতিরোধহীনভাবেই জারি থাকছে?
এর কারণ অনেক। আপাত মনে হচ্ছে, মবের দৌরাত্ম্যকে আশকারা দেওয়া হচ্ছে; মবের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করাকে শ্রেয়তর মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার আগে বিএনপি শাসনামলেও ভিন্ন পদ্ধতিতে একই কাজ করা হতো। এ বিষয়ে উপদেষ্টাদের নিশ্চুপতা মবকেন্দ্রিক ভয়কে এক রকম স্বীকৃতি দিচ্ছে।
হতাশার বিষয়, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকেও মব সহিংসতার বিরুদ্ধে বেশি জোরালো উচ্চারণ শুনছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। গত তিন মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হেনস্তার ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন এর বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেনি। বরং বর্তমানে দেখেছি ‘প্যাট্রোলিং’ করার নামে বিভিন্ন গ্রুপের ছাত্ররা ক্ষমতা জাহিরের চেষ্টা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় যদি মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নিরাপত্তা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে জনবল প্রয়োজন; প্রয়োজনে আউটসোর্সিং করবে; বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রেঞ্জার, স্কাউট, বিএনসিসি সদস্যদের কাজে লাগাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আয়োজনে এর আগেও তারাই দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু এদের দূরে রেখে এলোপাতাড়ি দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্নমুখী ক্ষমতাচর্চাই উৎসাহিত করা হচ্ছে।
মনে রাখা জরুরি ছিল, গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, জনতাসহ সব শ্রেণি-পেশার অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর সবার মতামতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার বদলে, অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির বদলে মবই নির্ধারণ করছে অনেক কিছু।
তাহলে স্বরাষ্ট্র কিংবা আইন মন্ত্রণালয়ে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের ওপর মবের সমর্থকদের আস্থা নেই?
আমরা জানি, যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, সবাই গণঅভ্যুত্থানের নেতা ও সমর্থকদের সমর্থনেই শপথ নিয়েছেন। তাহলে তাদের কাজ করতে না দিয়ে ‘মব ট্রায়াল’ হচ্ছে কেন?
সরকার পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে ছাত্রনেতৃত্বসহ গণঅভ্যুত্থানের সমর্থক পক্ষগুলোর আপত্তি থাকতেই পারে। আপত্তির বিষয়গুলো উপদেষ্টাদের জানাতে হবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। যদি উপদেষ্টা পরিষদ সেই আপত্তিগুলো নিরসনে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্দোলনের আংশীজনকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় ঠিক হতে পারে। তার বদলে মবোক্রেসির চর্চা আর যা-ই হোক, কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না।
মবোক্রেসি দেখে মনে হতে পারে, দেশে দুই রকম শাসন ব্যবস্থা চলছে? একটি ফরমাল, আরেকটি ইনফরমাল? নাকি প্রভাবশালী পক্ষগুলো যা নিজেরা করতে পারছে না; সেটি মব দিয়ে করাচ্ছে?
যদি সেটা না হয়, তাহলে সরকারের উচিত হবে বিষয়টি পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা-বহির্ভূত যে কোনো উদ্যোগকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
সবচেয়ে ঝুঁকির জায়গা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এই ‘মব কালচার’ যদি স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসে, তাহলে ভয়াবহ বিপদ। অনেক বিপদের একটি হলো, এটি চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরানো কঠিন হবে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান– জাতীয় জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকেই শিক্ষার্থীরা জাতিকে পথ দেখিয়েছে। তারা জাতির জন্য অভয় হয়ে এসেছে। এখন যেভাবে একজন ক্রেতাও ‘তাইলে কিন্তু ছাত্রদের ডাকব’ বলছে, সেটা খোদ শিক্ষার্থীদের জন্যই কোনোভাবে স্বস্তিকর হতে পারে না; কাঙ্ক্ষিতও নয়। বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। সূত্রঃসমকাল
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com