রাইফেলের গুলির শব্দ একসময় স্তব্ধ করতে চেয়েছিল তাঁর কণ্ঠ। তবে তা পারেনি। বরং সেই গুলি তাঁকে আরও দৃঢ়চেতা আর সংগ্রামী করে তুলেছে। আফগানিস্তানের নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আজও সোচ্চার সেই কিশোরী। যিনি আজ সারা বিশ্বে পরিচিত মালালা ইউসুফজাই নামে। তালেবানের শাসনে নারী অধিকারের চরম লঙ্ঘন নিয়ে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মালালা যেমন দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তেমনি নতুন প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বার্তাও দিয়েছেন।
তালেবানের শাসনে নারীদের দুঃস্বপ্ন-
২০২১ সালে পশ্চিমা-সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তালেবান। এর পর থেকে আফগানিস্তানের নারীদের জীবন এক গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছে। মালালা বলেন, “আমি কখনোই ভাবিনি, আফগান নারীদের অধিকার এত সহজে হারিয়ে যাবে।” মাত্র তিন বছরের শাসনে তালেবান নারীদের একের পর এক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে প্রায় ১০ লাখ মেয়ে শিশু ও কিশোরী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে, আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে প্রায় এক লাখ নারী।
মালালার মতে, “তালেবান জানে, নারীদের অধিকার ধ্বংস করতে হলে আপনাকে একেবারে ভিত্তি থেকে শুরু করতে হবে। আর সেই ভিত্তি হলো শিক্ষা।” তাই প্রথম থেকেই তারা নারীদের শিক্ষার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
তালেবানের নারীবিদ্বেষী কার্যকলাপ মালালার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২০১২ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্কুলের বাসে বসে তালেবানের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন তিনি। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়ে পরবর্তীতে নারী অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান তিনি। সেই সাহসিকতার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ২৭ বছর বয়সী মালালা বলেন, “আজ আফগান নারীদের অবস্থা হতাশাজনক। তাঁরা নিজেদের এমন এক বাস্তবতায় খুঁজে পাচ্ছেন, যেখানে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই।”
চলচ্চিত্রে আফগান নারীদের করুণ চিত্র-
মালালা তাঁর প্রযোজিত চলচ্চিত্র ‘ব্রেড অ্যান্ড রোজেস’ এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তালেবান শাসনে আফগানিস্তানের তিন নারীর জীবনসংগ্রাম। এই নারীদের মধ্যে আছেন জাহরা একজন দাঁতের চিকিৎসক, যাঁকে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আছেন তারানোম, যিনি তালেবানের ভয়ে দেশ ছেড়েছেন। আর আছেন শরিফা, যিনি চাকরি হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়েছেন।
মালালা জানান, এই চলচ্চিত্র শুধু তিনজনের গল্প নয়; এটি আফগানিস্তানের ২ কোটি নারীর প্রতীকী চিত্র। “তাঁদের প্রতিটি গল্প গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সব গল্প তুলে ধরা সম্ভব হয়নি।”
লড়াইয়ের আশা ও আহ্বান-
তালেবানের এই দমননীতি নিয়ে মালালার কণ্ঠে হতাশা থাকলেও তিনি থেমে যাননি। তিনি বলেন, “আফগান নারীদের অধিকার পুনরুদ্ধারে আমাদের বৈশ্বিক সমর্থন প্রয়োজন। তাঁদের কণ্ঠকে শক্তিশালী করতে হবে।”
বিশ্বের কাছে মালালার এই আহ্বান কেবল আফগান নারীদের জন্য নয় বরং সমস্ত সেই নারীদের জন্য, যাঁদের কণ্ঠ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মালালা তাঁর লড়াই ও উদ্যোগের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, সাময়িক নিস্তব্ধতা কোনো কণ্ঠকে চিরদিন থামিয়ে রাখতে পারে না।