- ‘নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতি’ সন্ত্রাসীদের কার্যক্ষমতায় সামরিক অভিযানের প্রভাবের তুলনায় অনেক বেশি।
- বিদ্যমান সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন স্পষ্ট, তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং ‘আফগানিস্তান ফ্যাক্টর’ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
গোয়েন্দা প্রধানের ভুল বিশ্লেষণ-
পাকিস্তানের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তরের একটি ছোট তবে জাঁকজমকপূর্ণ মিলনায়তনে, তখনকার গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদ বিশাল এলসিডি স্ক্রিনে স্লাইড দেখিয়ে দাবি করেছিলেন যে আফগান তালেবান বিদ্রোহ আসলে ‘পশতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’।
কিন্তু উপস্থাপনার শেষ দিকে তিনি নিজেই উল্টো কথা বলে বসলেন: “অনেকেই একমত হবেন না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং আফগান তালেবান একই মুদ্রার দুই পিঠ।”
কিছু সপ্তাহ পর, কাবুলের এক হোটেলে দাঁড়িয়ে, চ্যানেল ৪ নিউজের সাংবাদিক লিন্ডসে হিলসামকে তিনি বলেছিলেন, চিন্তা করবেন না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আজ, সামরিক বিচারের সম্মুখীন হয়ে তিনি হয়তো ভাবছেন, কীভাবে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আফগান তালেবান ও টিটিপির সম্পর্কের বিশ্লেষণে এত বড় ভুল করল।
সন্ত্রাস বৃদ্ধির ভয়াবহ পরিসংখ্যান-
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা ও প্রাণহানির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
- ২০২১ সালে খাইবার পাখতুনখোয়ায় সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা ছিল ৫৭২, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,১৭৩- প্রায় ২৭৯.৮ শতাংশ বৃদ্ধি।
- একই সময়ে প্রাণহানির সংখ্যা ২৩৮ থেকে বেড়ে ৭৮৮ হয়েছে, যা ২৩১ শতাংশ বৃদ্ধি।
- ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে হামলার সংখ্যা ৫৪.৮৯ শতাংশ বেড়েছে, আর প্রাণহানির হার বেড়েছে ১১.৯ শতাংশ।
- গড়ে প্রতিদিন দুইজনের মৃত্যু হচ্ছে, যার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, পুলিশ এবং সাধারণ নাগরিক রয়েছেন।
খাইবার পাখতুনখোয়ার দক্ষিণাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের প্রকোপ বেশি, বিশেষ করে দুই ওয়াজিরিস্তান, ডেরা ইসমাইল খান, ট্যাঙ্ক, লাকি মারওয়াত ও কারাক অঞ্চলে। মালাকান্ড ও হাজারা তুলনামূলক শান্ত থাকলেও ২০২৪ সালের মার্চে বিশাম ও শাংলায় চীনা শ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনা ব্যতিক্রম।
আফগানিস্তান ইস্যু-
পাকিস্তানের পশ্চিম প্রতিবেশী আফগানিস্তান এখনো সমস্যা সৃষ্টি করছে। তালেবান সরকার দাবি করছে, তারা টিটিপির সদস্যদের সীমান্ত এলাকা থেকে মধ্য আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশে স্থানান্তর করছে।
পাকিস্তান তালেবানদের বলেছে, তারা যেন টিটিপির কাছ থেকে উন্নত মার্কিন অস্ত্র উদ্ধার করে এবং সীমান্ত অতিক্রমে বাধা দেয়। কিন্তু ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে- আফগান সরকার বিনা বাধায় টিটিপিকে চলাফেরা করতে দিচ্ছে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব-
সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে রাজনৈতিক মালিকানা গ্রহণের বিষয়টি সাম্প্রতিক এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আলোচিত হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী খাইবার পাখতুনখোয়া সরকারকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র প্রাদেশিক সরকারের অনুরোধে সেখানে মোতায়েন রয়েছে এবং সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
এদিকে, সামরিক বাহিনী বলেছে যে, সন্ত্রাস মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, কারণ টিটিপি উন্নত মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে।
সন্ত্রাস দমনের বর্তমান কৌশল ব্যর্থ?-
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বর্তমানে টিটিপিকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের পুরোপুরি নির্মূল করতে পারেনি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সময় এসেছে কৌশল পুনর্বিবেচনা করার। গেরিলা যুদ্ধ মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যবহার, নজরদারি, রাজনৈতিক, আইনি এবং প্রশাসনিক সংস্কারের ওপর আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন।
নিষ্কর্ষ-
সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের বর্তমান কৌশল কার্যকর হচ্ছে না বরং টিটিপির বিস্তার বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক বিভক্তি, তালেবানদের দ্বৈত ভূমিকা এবং সামরিক অভিযান চালানোর প্রতি জনসমর্থনের অভাব- এসব কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়েছে। এখন সময় এসেছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের, যা আধুনিক প্রযুক্তি এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে।
সূত্র: DAWN. ভাষান্তর- এফ.আর. ইমরান