ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো সংযোগগুলোর একটি। আধুনিক সীমানা নির্ধারণের বহু আগে থেকেই দুই দেশ বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মাধ্যমে যুক্ত ছিল। কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে কখনো বিভিন্ন সাম্রাজ্যের দখলদারির কারণে, কখনো ভারত-পাকিস্তান ভাগের কারণে, কখনো শীতল যুদ্ধের বৈশ্বিক ব্লক পলিটিকসের কারণে এ সম্পর্ক চাপে পড়েছে। এখন এ সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মুখে আছে নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণের কারণে।
তবে এর মধ্যেও দুই ভূখণ্ডের সম্পর্ক কখনোই পুরোপুরি ভেঙে যায়নি; বরং তা নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিয়েছে।
চলতি অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফর তারই একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। এ সফর দেখাচ্ছে, পুরোনো ঐতিহাসিক সম্পর্ক হারিয়ে যায়নি; বরং অঞ্চলের অনিশ্চিত ও পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও ভারত-আফগানিস্তান আবার সম্পর্ক পুনর্গঠন করছে এবং সেটিকে নতুন রূপে ফিরিয়ে আনছে।
সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফগানিস্তানকে বাণিজ্য ও সংস্কৃতি যুক্ত করে রেখেছে। মৌর্য সম্রাট অশোকের শাসন কাবুল-কান্দাহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁর শিলালিপি আজও আফগানিস্তানের পাথরে গ্রিক ভাষায় খোদাই করা আছে। এই অঞ্চল একসময়ে যে একই সাংস্কৃতিক পরিসরের অংশ ছিল, তা এসব শিলালিপি প্রমাণ করে।
প্রাচীন গান্ধার অঞ্চল (যার মধ্যে বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কিছু অংশ ছিল) বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও বিদ্যার বড় কেন্দ্র ছিল।
২০০১ সালে তালেবানের হাতে ধ্বংস হওয়া বামিয়ান বুদ্ধমূর্তিগুলো দেড় হাজার বছর ধরে এই অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সপ্তম শতকে ইসলাম এ অঞ্চলে এলেও সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি; বরং গজনভি, গুরিদ, লোদি, মোগল রাজবংশের আফগান শাসকেরাই বারবার ভারতীয় ইতিহাস গড়েছেন। তাঁরা সবাই কাবুল থেকে পার্বত্য পথ পেরিয়ে দিল্লিতে রাজবংশ গড়েন। ১৫২৬ সালে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে বাবর কাবুলের শাসক ছিলেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এ সম্পর্কের ধারা বদলে দেয়। উনিশ শতকে দুই দফা অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের ‘গ্রেট গেমে’ ব্রিটেন-রাশিয়ার হাতিয়ার হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। ১৮৯৩ সালের ডুরান্ড লাইন অ্যাগ্রিমেন্ট বা ডুরান্ড চুক্তি পশতু এলাকাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে একটি কৃত্রিম সীমানা টেনে দেয়, যা আজও অঞ্চলটির দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের মূল কারণ হয়ে আছে। আফগানিস্তান কখনো এ সীমানাকে মেনে নেয়নি। সীমানা ইস্যুতে কাবুলের এ অবস্থান এখনো পাকিস্তান-আফগান উত্তেজনার মূল কারণ।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আফগানিস্তানের গভীর সহানুভূতি ছিল। ‘সীমান্ত গান্ধী’–খ্যাত খান আবদুল গফফার খান খুদাই খিদমতগার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি পশতুনদের অহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগঠিত করেছিলেন এবং ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন।
দেশভাগের পর জাতিসংঘে পাকিস্তানের সদস্যপদ অনুমোদনের বিরুদ্ধে একমাত্র আফগানিস্তান ভোট দিয়েছিল। ডুরান্ড লাইনের কারণে নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স (বর্তমান খাইবার পাখতুনখাওয়া) আফগানিস্তানে যুক্ত না হয়ে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাওয়ায় আফগানিস্তান এই ভোট দিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে ভারত ও আফগানিস্তান একটি ‘মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। পাকিস্তানের পশ্চিমা জোটে যোগদান নিয়ে দুই দেশই ক্ষুব্ধ ছিল। এই ইস্যুতে তাদের অবস্থান কাছাকাছি হয়।
শীতল যুদ্ধের সময় ভারত ও আফগানিস্তান দুই দেশই মস্কোর দিকে ঝুঁকে ছিল। ভারত মনে করত, সোভিয়েত উপস্থিতি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করবে এবং আফগান মাটি ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হবে না, সেটিও নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে পাকিস্তান হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব–সমর্থিত জিহাদের সম্মুখসারির রাষ্ট্র।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার পর দেশটি অরাজকতায় ডুবে যায়। পুরোনো শাসনব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা ভারত সেখানে প্রভাব হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখল করলে নয়াদিল্লি আবার সক্রিয় হয়। ভারত ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে মিলে আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বাধীন নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করে।
এ সমর্থনের পেছনে ছিল ভারতের কৌশলগত হিসাব। ভারতের কাছে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের মানে ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তানি প্রভাবের সম্প্রসারণ। ভারত আশঙ্কা করেছিল, তালেবানশাসিত আফগানিস্তান ভারতবিরোধী জঙ্গিদের আশ্রয় দেবে ও সমর্থন করবে। ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই আশঙ্কা সত্যি হয়।
২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারত আফগানিস্তানের অন্যতম বৃহৎ আঞ্চলিক বিনিয়োগকারী হিসেবে উঠে আসে। ভারত সাড়ে ২৭ কোটি ডলার ব্যয়ে আফগান-ভারত মৈত্রী বাঁধ (পুরোনো সলমা ড্যাম) তৈরি করে। এ ছাড়া ভারত আফগানিস্তানকে ইরানের চাবাহার বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম জারাঞ্জ-দেলারাম সড়ক তৈরি করে।
তবে ২০০৮ সালে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে বোমা হামলা এবং ভারতের একাধিক কনস্যুলেটে হামলার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পাকিস্তানি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী থাকা এলাকায় কাজ করাটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ায় তালেবান আবার ক্ষমতায় ফেরে। ভারত দূতাবাস বন্ধ করে দূতদের সরিয়ে নেয়। তখন মনে হয়েছিল, দুই দশকের বিনিয়োগ বুঝি রাতারাতি হারিয়ে গেল। এ কারণে ওই সময় পাকিস্তানের নেতারা উল্লসিত হয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের ধারণা ছিল, আফগানিস্তানে আবার তাঁদের প্রভাব বাড়বে। কিন্তু তালেবান শিগগিরই তাঁদের হতাশ করে। এটাই ভারতের জন্য ছোট হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সুযোগ তৈরি করে দেয়।
২০২৫ নাগাদ আফগানিস্তান ও ভারত—দুই দেশই নতুন ধরনের সম্পর্ক তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নামে। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অংশীদার দরকার ছিল। আর ভারতের দরকার ছিল উন্নয়ন, বাণিজ্য ও মানবিক সহায়তার মাধ্যমে আবার আফগানিস্তানে পা রাখার সুযোগ।
আমির খান মুত্তাকির নয়াদিল্লি সফর থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই দুই পক্ষই বাস্তবতার ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনর্গঠনে আগ্রহী হয়েছে।
ভারতের তালেবান যোগাযোগ একটি বাস্তবতানির্ভর প্রতিক্রিয়া।
তবে দুই দেশের সম্পর্কের আগামী পথ এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে। নারী অধিকার ও সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে তালেবানের রেকর্ড অত্যন্ত খারাপ। সেখানে নিরাপত্তাঝুঁকিও আছে। তবে এটি নিশ্চিত—ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের কাহিনির এখানেই শেষ নয়। এ সম্পর্ক কেবল নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে পুরোনো বন্ধন ও নতুন বাস্তবতা একসঙ্গে বেঁচে থাকার পথ খুঁজছে।
-
অজয় দর্শন বেহেরা পরিচালক, এমএমএজে একাডেমি অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, নয়াদিল্লি। সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

