প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও সুপারকম্পিউটারের গুরুত্ব দ্রুত বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গুগল নিয়ে এসেছে এক্সাস্কেল কম্পিউটিং প্রযুক্তি, যা কম্পিউটিং ক্ষমতার এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। প্রতি সেকেন্ডে এক ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটি) গণনার সক্ষমতাসম্পন্ন এই সুপারকম্পিউটারটি গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে। এটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের গতিকে ত্বরান্বিত করছে এবং নতুন সম্ভাবনার পথ তৈরি করছে।
এক্সাস্কেল কম্পিউটিং কী?
এক্সাস্কেল কম্পিউটিং হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যা বিশাল পরিমাণ তথ্য সেকেন্ডের মধ্যে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে। “এক্সা” শব্দটি এক বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থাৎ ১০^১৮ গণনার ইঙ্গিত দেয়। এর অর্থ হলো প্রতি সেকেন্ডে এক্সাস্কেল কম্পিউটার প্রায় এক ট্রিলিয়ন ফ্লোটিং পয়েন্ট অপারেশন সম্পন্ন করতে সক্ষম। এটি কেবলমাত্র সুপারকম্পিউটিং জগতে একটি মাইলফলক নয় বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এক বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিপ্লব-
এক্সাস্কেল কম্পিউটারগুলোর অসামান্য গণনক্ষমতা বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশবিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষকরা এর মাধ্যমে জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান দ্রুততর করতে পারছেন। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা পাওয়া এবং এর সম্ভাব্য প্রভাবের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এক্সাস্কেল কম্পিউটার অমূল্য তথ্য সরবরাহ করছে। এটি বিজ্ঞানীদের জলবায়ুর বিভিন্ন মডেল তৈরি করতে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করছে।
এছাড়াও ব্ল্যাকহোলের তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং মহাবিশ্বের শুরুতে কী ঘটেছিল তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই সুপারকম্পিউটার ব্যবহার করা সম্ভব। ছায়াপথের সৃষ্টি ও বিবর্তন বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি জিনোম ম্যাপিংয়ের জটিলতা সহজ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাতেও এর ব্যবহার হচ্ছে। জিনোম ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা দ্রুততর হচ্ছে, যার ফলে নতুন ওষুধ আবিষ্কারসহ অনেক জটিল রোগের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে গুগলের নতুন দিগন্ত-
এক্সাস্কেল কম্পিউটারের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হচ্ছে এটির মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিকাশ। গুগল, এআই গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে, এক্সাস্কেল কম্পিউটারের সাহায্যে এআইকে নতুন স্তরে নিয়ে যেতে চাইছে। এই প্রযুক্তি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ককে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজকে আরও কার্যকর এবং দ্রুততর করতে সক্ষম। এর ফলে চালকবিহীন গাড়ি, রোবোটিকস এবং অন্যান্য অটোমেশন প্রযুক্তি আরও উন্নত ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হবে। গুগলের এক্সাস্কেল কম্পিউটার এসব ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এআই ও চালকবিহীন গাড়ির ভবিষ্যৎ-
গুগলের এক্সাস্কেল কম্পিউটিং প্রযুক্তি এআই-এর মাধ্যমে চালকবিহীন গাড়ির বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এই কম্পিউটারগুলো এত দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে যে, এটি অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির চেহারা পাল্টে দিতে পারে। স্বচালিত গাড়ি, যা ট্রাফিক সংকেত বা রাস্তার অবস্থা অনুসারে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেবে, এই প্রযুক্তির কারণে শীঘ্রই বাস্তবে পরিণত হতে পারে।
এছাড়া রোবোটিকসের ক্ষেত্রেও এক্সাস্কেল কম্পিউটারের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আরও দক্ষ, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বুদ্ধিমান রোবট তৈরির মাধ্যমে মানবিক কাজ সহজতর করা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, জটিল অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে রোবটকে সফলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
শক্তি এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ-
এক্সাস্কেল কম্পিউটার চালানোর জন্য প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয়। এ ধরনের কম্পিউটারগুলো ব্যাপক তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিশাল শক্তি ব্যবহার করে, যা একটি বড় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে গুগল, একটি পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানের পরিচয়ে নিজেদের তুলে ধরতে সচেষ্ট। তারা এই সুপারকম্পিউটারগুলো চালানোর জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করার দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে এই প্রযুক্তি পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা-
এক্সাস্কেল কম্পিউটিং প্রযুক্তি চালু করে গুগল বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এই প্রযুক্তি শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা সুপারকম্পিউটিং-এর ভবিষ্যৎই নয় বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিল ও সময়সাপেক্ষ সমস্যার সমাধানেও বিপ্লব ঘটাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, স্বাস্থ্যসেবায় নতুন ওষুধের উদ্ভাবন, মহাকাশ অনুসন্ধান এবং এআই-এর উন্নতির মতো ক্ষেত্রগুলোতে গুগলের এক্সাস্কেল কম্পিউটার যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। এটি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সুপারকম্পিউটিং-এর এই যুগান্তকারী ধাপটি কেবল বর্তমান প্রজন্মের গবেষণা নয় বরং ভবিষ্যতের উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত করবে। এক্সাস্কেল কম্পিউটিং প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে গবেষকদের জন্য অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।