সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের দায়িত্ব পালনে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবার বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এবার থেকে তাদের প্রতি বছরের কর্মক্ষমতা বা পারফরম্যান্স মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রেও আগের পারফরম্যান্সকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ‘চেয়ারম্যান/পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা–২০২৫’ শিরোনামে নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে। এটি কার্যকর হবে সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক, সরকারি শেয়ারধারী বেসরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে।
এর আগে ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল একই বিষয়ে একটি নীতিমালা জারি হয়েছিল। কিন্তু পরে বিশ্বব্যাংক মতামত দিয়ে বলেছিল, সরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের ওপর যথেষ্ট জবাবদিহি আর স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়নি। সেই পর্যালোচনা থেকেই নতুন এই সংস্কারমুখী নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে হলে প্রার্থীর পেশাগত যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকবে অগ্রাধিকার তালিকায়। অর্থনীতি, ব্যাংকিং, পুঁজিবাজার, মুদ্রানীতি, ঋণ ব্যবস্থাপনা, করপোরেট গভর্ন্যান্স, ব্যবসা প্রশাসন, কৃষি, শিল্প, আইন বা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা প্রাধান্য পাবেন।
এছাড়া, সরকারের বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কোনো পেশাজীবীকেও নিয়োগ দেওয়া যাবে। তবে যার ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক স্বার্থের সংঘাত রয়েছে, তিনি এই পদে বিবেচিত হবেন না।
সরকারি সচিব বা সমগ্রেডভুক্ত কর্মকর্তারা সাধারণত এই পদে নিয়োগযোগ্য থাকবেন না, যদি না আলাদা নির্দেশে অনুমোদন থাকে।
নীতিমালায় পরিচালনা পর্ষদে বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। পর্ষদে অন্তত একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, একজন আইনজ্ঞ এবং একজন অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার থাকতে হবে।
নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এক-তৃতীয়াংশ পরিচালক পদে যোগ্য নারী প্রার্থীদের নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সুযোগও রাখা হয়েছে।
চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের কাজের মান ও ফলাফল প্রতি বছর মূল্যায়ন করা হবে নির্দিষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে। এই পারফরম্যান্স মূল্যায়নই নির্ধারণ করবে তাদের পুনঃনিয়োগের সম্ভাবনা। পাশাপাশি, দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও চালু করতে হবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে।
চেয়ারম্যান বা পরিচালক নিয়োগে একটি বাছাই কমিটি কাজ করবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন লাগবে। তবে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টার অনুমোদনই যথেষ্ট।
প্রার্থীকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, বয়স ৪৫ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে। থাকতে হবে অন্তত ১০ বছরের প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনাগত বা পেশাগত অভিজ্ঞতা।
যারা ফৌজদারি অপরাধ, দুর্নীতি, আর্থিক প্রতারণা বা কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত, তারা এই পদের জন্য অযোগ্য। দেউলিয়া ব্যক্তি বা ঋণখেলাপিরাও মনোনয়ন পাবেন না। এছাড়া কেউ একই সময়ে একাধিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।
পাশাপাশি, কোনো ব্যক্তি যদি গত পাঁচ বছরের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক, উপদেষ্টা, নিরীক্ষক বা বেতনভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত থাকেন, তবে তিনিও পরিচালক পদে বিবেচিত হবেন না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন এই নীতিমালা মূলত সরকারি ব্যাংকগুলোর স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব বাড়াতে একটি কাঠামোগত উদ্যোগ। অতীতে রাজনৈতিক প্রভাব ও অদক্ষ নেতৃত্বের কারণে যে আর্থিক অনিয়ম ও ঋণখেলাপির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, এই মূল্যায়নভিত্তিক ব্যবস্থা তা ভাঙার এক ইতিবাচক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

