গাজার মোনা, যার বাড়ি সমুদ্রের একদম কাছে। সবসময় সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মনকে শান্ত করতেন। কিন্তু ইসরায়েল-গাজার চলমান যুদ্ধ তার সেই শান্ত জীবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। সমুদ্র এখন তার কাছে আর মুক্তির প্রতীক নয় বরং মৃত্যুর নীরব সাক্ষী।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মোনাকে একাধিকবার আশ্রয়শিবির বদলাতে হয়েছে। ড্রোন আর বিমান হামলার ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই তাকে এক কঠিন বাস্তবতায় ঠেলে দেয়। অবশেষে দুই সন্তান এবং গর্ভে থাকা তৃতীয় সন্তান নিয়ে তিনি মিশরে পালাতে সক্ষম হন। তবে, স্বামীকে গাজায় রেখে আসতে বাধ্য হন।
মোনার মতো আরও অনেক ফিলিস্তিনি মিশরে পালিয়ে এসেছেন। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সংস্থার সাহায্যে পালাতে পেরেছেন। মোনার ক্ষেত্রে, একটি মিশরীয় সংস্থার মাধ্যমে পালানোর ব্যবস্থা হয়। তবে শোনা যায়, এই সংস্থার সঙ্গে মিশরের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা জড়িত। মিশর সরকার অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এই ঘটনা গাজার যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা থেকে শুরু হয়ে মিশরের কায়রোতে গিয়ে শেষ হয়। বর্তমানে মিশরই মোনার অস্থায়ী আশ্রয়স্থল।
ইসরায়েল-গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মোনার এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সূত্রপাত। সম্প্রতি মোনার গর্ভস্থ সন্তান জন্ম নিয়েছে, যা তার কায়রোয় অবস্থানের এক গুরুত্বপূর্ণ সময় চিহ্নিত করে।
গাজার যুদ্ধ এবং এর ফলে সৃষ্ট মানবিক সংকট মোনার জীবনকে বদলে দিয়েছে। তার এবং তার পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াই তাকে গাজার বাইরে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। অর্থ ও নিরাপত্তার অভাবে পুরো পরিবার একসঙ্গে পালাতে পারেনি।
মোনা তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেন, যা দিয়ে তিনি সন্তানদের নিয়ে মিশরে পালানোর ব্যবস্থা করেন। তবে এত খরচের পর স্বামীকে নিয়ে আসার মতো অর্থ আর ছিল না।
মিশরে এসে মোনা পরিচিত হন লুসি নামে এক জার্মান মানবাধিকার কর্মীর সঙ্গে, যিনি প্রায় দুই দশক ধরে কায়রোয় আছেন। লুসির সহায়তায় মোনা সন্তান জন্ম দেন এবং বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ছয় বছরের মেয়ে, চার বছরের ছেলে এবং সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে এই নতুন পরিবেশে টিকে থাকার চেষ্টায় আছেন।
মিশরে পালিয়ে আসা ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি আর মানবাধিকার কর্মীদের তথ্য ভিন্ন। মিশর সরকার বলছে, এই সংখ্যা প্রায় এক লাখ। তবে বাস্তব সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। যারা পালিয়ে এসেছেন, তারা মৌলিক অধিকার—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ-কোনো কিছুই পাচ্ছেন না।
মোনার গল্প কেবল একটি নির্দিষ্ট ঘটনার বর্ণনা নয়; এটি যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রতিফলন। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে পালিয়ে মিশরে আশ্রয় নেয়া মানুষেরা এখনো শান্তির দেখা পাননি। তাদের লড়াই নতুন দেশে বেঁচে থাকার জন্য, যেখানে জীবন নিশ্চিত নয়, নিরাপত্তা নেই, আর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
এই গল্প মোনার হলেও, এটি প্রতিদিন পালিয়ে আসা অসংখ্য মানুষের সংগ্রামেরই প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধ শুধু সীমান্ত নয়, ভেঙে দেয় পরিবার, মানুষ আর তাদের জীবনের প্রতিটি স্তর।