পুলিশ বাহিনীকে মানবিক ও জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছেন নৌপরিবহন এবং বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন।
শনিবার ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (এসআইপিজি) আয়োজিত “জনমুখী পুলিশ সেবা নিশ্চিতকল্পে পুলিশ কমিশন গঠন ও অন্যান্য সংস্কারের প্রস্তাব” শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বক্তৃতার শুরুতেই উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন চলমান সরকারের পুলিশ সংস্কার কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, বর্তমান পুলিশ ব্যবস্থা থেকে রাজনীতিকরণ মুক্ত মানবিক পুলিশ বাহিনী গঠন অপরিহার্য। উপদেষ্টা ৮ আগস্টের পর পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের সঙ্গে আলাপের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “তারা নিজেরা আর রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হতে চায় না। তাদের দাবি, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশনের মাধ্যমে পুলিশের কাঠামোগত সংস্কার হওয়া প্রয়োজন।” তিনি কমিশনের প্রধান হিসেবে একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাবও দেন এবং কমিশনের সদস্য সংখ্যা পাঁচের বেশি না রাখার পরামর্শ দেন।
তিনি আরও বলেন, রক্তক্ষয়ী জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের পর এখন জনগণের আস্থা অর্জনই পুলিশের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। পুলিশ বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন করতে জনসাধারণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। তিনি শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবামূলকভাবে ট্রাফিক সামলানোর কাজে পুলিশের পাশে দাঁড়ানোর প্রশংসা করেন এবং থানায় থানায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন।
পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে জেলাভিত্তিক নিয়োগের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় নিয়োগ ব্যবস্থা চালুর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমার মতে, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বাধীন পুলিশ কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া উচিত।” তিনি আরও যোগ করেন যে, বর্তমানে পুলিশের নিম্নপর্যায়ের সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা কম এবং পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। এতে হতাশা বাড়ছে এবং এর ফলে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি রোধে পুলিশ সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস করার কথা বলেন তিনি।
সেমিনারে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও বক্তব্য রাখেন। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, “আমরা পুলিশ কমিশন গঠনের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে পুলিশের রাজনীতিকরণ কমানো সম্ভব হবে।” বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব এস. এম. জহিরুল ইসলাম বলেন, “যোগ্য, মেধাবী ও বিশ্বস্ত সদস্যদের সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। জনগণের স্বার্থে আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন বলেন, “পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি সংস্কারের অংশ হিসেবে গুরুত্ব পাওয়া উচিত।” অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. মাহবুবুল করিম বলেন, “পুলিশ কমিশন গঠনের পথে আমরা এগোতে পারি, তবে পুলিশ সংস্কারকে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখা ঠিক হবে না।” তিনি পুলিশের সংস্কারকে একটি জাতীয় শুদ্ধি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনার আহ্বান জানান।
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গবেষণা ও সংলাপের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। সেমিনারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন, যারা একযোগে মানবিক পুলিশ বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের গুরুত্বের ওপর জোর দেন।