ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি ছাড়া বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে চলা এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এই মূল্যবান শিক্ষা ইতিহাসের পাতা থেকে স্পষ্ট। রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনায় আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা এ মত প্রকাশ করেন। আলোচনার বিষয় ছিল “মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রেক্ষিতে সত্য, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও প্রতিকার; আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার তুলনামূলক অভিজ্ঞতা।” বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজ যৌথভাবে এই আলোচনা আয়োজন করে।
আলোচনায় দক্ষিণ সুদানের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ কমিশনের প্রধান ইয়াসমিন সুকা বলেন, “অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যা নিয়ে সমাজকে লড়াই চালাতে হয়। আমাদের দেশে (দক্ষিণ আফ্রিকা) রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ১৫ বছর পরেও ২০০-এর বেশি মামলা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা করার চেষ্টা করেছি। এর উদ্দেশ্য ছিল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ন্যায়বিচারের আওতায় আনা।”
তিনি আরও বলেন, “যখন আমরা বিভেদ ঘুচিয়ে চলার কথা বলি, তখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া তা সম্ভব নয়। ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি ছাড়া রিকনসিলিয়েশন কেবল কাগজে-কলমেই থাকে। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং হলেও অসম্ভব নয়।”
ইয়াসমিন সুকা উল্লেখ করেন, প্রমাণের অভাব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাক্ষ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণে প্রসিকিউটরদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার কার্লোস ক্যাস্ট্রেসানা ফার্নান্দেজ বলেন, “বিচার অতীতের ভুলগুলোকে শুধরাতে না পারলেও এটি অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করে এবং প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে।”
গুয়াতেমালায় দায়মুক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ফার্নান্দেজ বলেন, “গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়; এটি আইন অনুসরণ করে চলার একটি প্রক্রিয়া। সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, তবে নির্যাতনের সংজ্ঞাটি আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।”
আলোচনায় সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন ব্লাস্টের সম্মাননীয় নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। ন্যায়বিচার ও বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়ই দেখা যায়, আদালতগুলো অতিরিক্ত চাপে থাকে। এই পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজ কীভাবে ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে, তা নিয়ে ভাবা জরুরি।”
সভাপতির বক্তব্যে ব্লাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুল বারী বলেন, “বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।”
আলোচনায় উঠে আসে, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে জাতীয় ঐক্যের মতো বৃহৎ লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকা, সিয়েরা লিওন এবং লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অতীতের ভুলগুলো শুধরানো না গেলেও এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুশাসনের ভিত্তি তৈরি করতে পারে।