২০২৫ সালের ৫ মে, ঢাকা শহরের প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হলো ‘কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন ২০২৫’। যা দেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনায় আনে। বণিক বার্তা আয়োজিত এ সম্মেলনটি তিনটি পৃথক অধিবেশনে বিভক্ত ছিল এবং এতে দেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রথম অধিবেশন: খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যতা
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনটি ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যতা’ বিষয়ে ছিল। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
তিনি বলেন, “কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু এটি করতে গিয়ে কৃষকের ক্ষতির দিকটি অবহেলিত হচ্ছে। আমাদের খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে হবে, যাতে কৃষকও লাভবান হন এবং ভোক্তাদের নিরাপদ খাদ্য পৌঁছানো সম্ভব হয়।” তিনি কৃষকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম কৃষি উন্নয়নে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয় যে, শুধু শস্য উৎপাদনের উন্নয়ন নয় বরং প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্য খাতের উন্নয়নও জরুরি।
দ্বিতীয় অধিবেশন: কৃষি উৎপাদন ও প্রাণ-প্রকৃতি
দ্বিতীয় অধিবেশনটির শিরোনাম ছিল ‘কৃষি উৎপাদন ও প্রাণ-প্রকৃতি’। যা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, “কৃষি এবং প্রকৃতি পরিপূরক। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে, তবে একই সঙ্গে প্রকৃতির সংরক্ষণও জরুরি।”
এছাড়া, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলাম কৃষি জমির সঠিক ব্যবহার এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “মাটির অণুজীবগুলি ধ্বংস হওয়ার কারণে উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছেনা। আমাদের মাটির গুণাগুণ রক্ষা করতে হবে।”
এ অধিবেশনে মাল্টিমোড গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ‘একই জমিতে বারবার চাষ করার প্রযুক্তি’র প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, “বাড়তি জনসংখ্যার চাপ এবং কৃষি জমির সংকোচন মোকাবিলা করতে হলে নতুন কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে।”
তৃতীয় অধিবেশন: খাদ্যের বাজার, সরবরাহ ও দেশজ সক্ষমতা
তৃতীয় এবং শেষ অধিবেশনটি ‘খাদ্যের বাজার, সরবরাহ ও দেশজ সক্ষমতা’ বিষয়ে ছিল। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, “কৃষি খাতের উন্নয়ন ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে, বিশেষ করে চাল, গম এবং অন্যান্য প্রধান খাদ্যশস্যে।”
এ অধিবেশনে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এবং কোয়ালিটি ফিডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহতেশাম বি শাহজাহান কৃষি খাতের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা কৃষকদের জন্য উন্নত ঋণ সুবিধা প্রদান এবং সাপ্লাই চেইন ছোট করার প্রস্তাব দেন।
তরুণদের কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা
আইইউবিএটির উপাচার্য ড. আব্দুর রব তরুণ প্রজন্মকে কৃষিতে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষিত তরুণরা যদি কৃষিকে ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করে, তবে এটি তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং চাকরির পেছনে না ছুটে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।”
সম্মেলনের মাধ্যমে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে একযোগে কাজ করার জন্য সরকার, উদ্যোক্তা, কৃষক ও পরিবেশবিদদের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কৃষির উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে একটি সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব হবে। সম্মেলনের বক্তারা খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষি খাতের জন্য সঠিক নীতি ও প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে কৃষক এবং ভোক্তা উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা যায়।