বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। গতকাল বুধবার (২১ মে) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ: রিভিউ ল’স অ্যান্ড প্রোটেক্ট হিউম্যান রাইটস স্ট্যান্ডার্ডস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের আইনপ্রণয়ন ও প্রশাসনিক উদ্যোগগুলো মৌলিক স্বাধীনতা খর্বের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
এইচআরডব্লিউ-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি এবং গুরুতর অনিয়মের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরিবর্তে- অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের সমর্থকদের অধিকার দমন করছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনের আওতায় ১২ মে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘অস্থায়ী’ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞার ফলে দলটির সভা-সমাবেশ, প্রকাশনা এবং অনলাইনে তাদের পক্ষে বক্তব্য বা বিবৃতি দেওয়াও নিষিদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা মোকাবিলায় গৃহীত আইন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করেনি এবং অপরাধীদের জবাবদিহিতাও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করতে পারছে না।
এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, “বিগত সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতে আইনের অপব্যবহার করেছিল। এখন একই কৌশল আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হলে, সেটিও মৌলিক স্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে।”
তিনি আরো বলেন, “জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় প্রস্তাবিত আইনের খসড়াও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে না এবং হাসিনার শাসনামলে গুম হওয়া শত শত ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের জন্য কোনো কার্যকর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা হয়নি।”
প্রতিবেদনে জানানো হয়, তিন সপ্তাহের বিক্ষোভে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হওয়ার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা হারায়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের আগে গণতান্ত্রিক নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে। সরকার ইতোমধ্যে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত আবারও উদ্বেগ তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংঘটিত অনিয়ম ও অপরাধের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় তা কার্যত দলটিকে নিষিদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করছে। দলটির সব কর্মকাণ্ড- প্রকাশনা, মিডিয়া, অনলাইন প্রচার, র্যালি, সভা, সমাবেশ, কনফারেন্স- সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে দলটির বহু বছর ধরে থাকা সমর্থকদের মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।
আরো বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার ঘোষণার পরই নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর সংশোধিত অধ্যাদেশের আওতায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশোধিত আইনে “সংগঠন” শব্দটির ব্যাখ্যা এত বিস্তৃতভাবে দেওয়া হয়েছে যে, দলটির সমর্থকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমর্থন জানানো পর্যন্ত অপরাধ বিবেচিত হতে পারে। ট্রাইব্যুনাল চাইলে এসব ব্যক্তিকেও শাস্তির আওতায় আনতে পারবে।
এই আইনের আওতায় ইতোমধ্যে বহু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত হত্যা মামলায় শিল্পী, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মীসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রসিকিউটররা তাদের ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনের সমর্থক’ হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার সমর্থন করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তে ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশন প্রাথমিকভাবে ১৬৭৬টি অভিযোগ পেয়েছে, যার মধ্যে এখনও ২০০ জন নিখোঁজ। কমিশন এসব গুমকে একটি “সিস্টেমিক ডিজাইন” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর গোপন বন্দিশিবিরে ভয়াবহ নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেছে।
তবে, গুম সংক্রান্ত প্রস্তাবিত আইনে এই কমিশনের অনুসন্ধানের ভূমিকা রাখা হয়নি। বরং এসব মামলা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সীমিত সম্পদ ও বিতর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ওপর- যার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে ‘প্রিভেনশন অ্যান্ড রেমেডি অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস’ নামে একটি নতুন জাতীয় কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে এর স্বাধীনতা রক্ষায় কোনো কার্যকর বিধান রাখা হয়নি। আর যারা গুমের জন্য সন্দেহভাজন, তাদের বিচার হবে একটি নতুন ট্রাইব্যুনালে। তবে যেসব গুম মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, সেগুলোর বিচার করাও এই কাঠামোর আওতায় সম্ভব নয়।
এইচআরডব্লিউ আরো জানায়, জোরপূর্বক গুমের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় অনেক ভুক্তভোগী পরিবারে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ২০১৩ সালে গুম হওয়া এক ব্যক্তির মা বলেন, “আমি এখনও আশা করি আমার ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু যদি না আসে, তাহলে যারা এটা করেছে, তাদের বিচার চাই- যাতে কেউ আর কোনো মায়ের সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার সাহস না করে।”
অন্যদিকে, ভুক্তভোগী পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলামের বাড়ি গত ৮ মে পুলিশ ঘেরাও করে, যা ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একটি স্থায়ী ভিত্তি গড়তে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা করা এবং নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। প্রমাণ ছাড়াই কাউকে রাজনৈতিক কারণে আটক রাখা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপপরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, “বিগত সরকারের শাসনের সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে, এতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েছে। কিন্তু বিরোধীদের অধিকার হরণ করাটা সঠিক পথ নয়। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নিখোঁজ ব্যক্তিদের ভাগ্য জানা ও অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।”