বাংলাদেশে প্রতি বছর যেমন বাড়ছে বজ্রপাতের পরিমাণ, তেমনি বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দেশে বজ্রপাতের হার বছরে গড়ে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে, আর এর জেরে প্রতিবছর প্রায় ৩৫০ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। এমন ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (২৮ জুন) প্রথমবারের মতো দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক বজ্রপাত নিরাপত্তা দিবস। “শুনলে বজ্রধ্বনি, ঘরে যাই তখনই”— এই সচেতনতামূলক স্লোগানে দিনটি উপলক্ষে রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
আবহাওয়া বিষয়ক আঞ্চলিক সংস্থা রাইমস–এর (রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি-হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম) আবহাওয়াবিদ খান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী সেমিনারে জানান, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩.৩৬ মিলিয়ন বজ্রপাত হয়। এর জেরে মৃত্যু হয় প্রায় সাড়ে তিনশ মানুষের। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেটকে। বিশেষ করে এপ্রিল ও মে মাসে বজ্রপাতের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের হার ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।”
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)-কে একটি সম্পূর্ণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে রূপান্তরের কাজ চলছে। এই নতুন কাঠামো শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, বরং সকল ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও তাৎক্ষণিক সহায়তায় কাজ করবে।
বজ্রপাতের সময় কী করতে হবে, সে বিষয়ে সেমিনারে দেওয়া হয় একাধিক দিকনির্দেশনা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বজ্রপাতের শব্দ শোনার পর শেষ বজ্রধ্বনির অন্তত ৩০ মিনিট পরে ঘরের বাইরে যাওয়া নিরাপদ। বজ্রপাতের সময় নিরাপদে থাকার জন্য যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে:
- আকাশ মেঘলা হলে বা বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেলে দ্রুত ঘরের ভিতরে আশ্রয় নিতে হবে।
- বাইরে থাকলে খোলা জায়গায় দাঁড়ানো যাবে না, বরং হাত-পা গুটিয়ে নিচু হয়ে বসতে হবে।
- কোনোভাবেই মাটিতে শোয়া যাবে না।
- পুকুর বা নদীতে থাকলে নৌকার ছাইয়ের নিচে অবস্থান করা উচিত। ছাই না থাকলে যতটা সম্ভব কম স্পর্শ রেখে বসতে হবে।
- বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে এবং জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে।
- গাছের নিচে দাঁড়ানো, উঁচু জায়গায় ওঠা কিংবা ধাতব কাঠামোর কাছাকাছি থাকা বিপজ্জনক।
- ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার বা বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে।
- খোলা ছাতা, ধাতব যাত্রী ছাউনি কিংবা খোলা তাঁবুর নিচে দাঁড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ একটি বজ্রপাতপ্রবণ দেশ, এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতে আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রতিবছর শত শত প্রাণহানি রোধে সতর্কতা, প্রস্তুতি এবং সচেতনতা—এই তিনটি বিষয়েই জোর দিতে হবে। সরকারি উদ্যোগ, স্থানীয় ভলান্টিয়ারদের সক্রিয়তা এবং গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারণাই পারে এই বিপদ থেকে মানুষের জীবন রক্ষা করতে। বজ্রপাতকে আর অবহেলার চোখে দেখা যাবে না—এখন সময় প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেওয়ার।