২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান দেশের জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থার কঠোর বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। এই বিদ্রোহের সময়ে গুরুতর আহত হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালগুলোর দ্বারস্থ হলেও বেশিরভাগই জরুরি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একদিকে বিশাল জনসংখ্যার চাহিদা, অন্যদিকে অত্যন্ত সীমিত চিকিৎসা সক্ষমতা—এই পরিস্থিতি দেশের স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতাকে আরও প্রকট করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি জরুরি সেবা কাঠামো উন্নত করা যায় এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, তবে এই অবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব।
যে দৃশ্যটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল, তা হলো আতিকুল ইসলাম নামের ১৯ বছরের এক তরুণের ঘটনা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিন পুলিশের গুলিতে আহত হন আতিক। গুলিবিদ্ধ এই ছেলেটিকে প্রথমে পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু কোথাও তিনি চিকিৎসা পাননি। অবশেষে তাকে নেওয়া হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেসে, সেখানে চিকিৎসকরা জানান তার হাতটি কেটে ফেলতে হবে। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা কোনো চিকিৎসা না পেয়ে শেষমেশ ৭ আগস্ট নিটোরে তার হাত কেটে ফেলা হয়। আতিকের হাস্যোজ্জ্বল মুখে সেই মর্মান্তিক কথা, “দেশের জন্য আরেকটি হাত হারাতেও রাজি আছি,” এই দেশের সেবার দৈন্যদশা ও জনগণের আত্মত্যাগের চিত্র পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলে।
অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়, বিশেষ করে ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত, বেসরকারি হাসপাতালগুলো হাজার হাজার আহত বিক্ষোভকারীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে, যদিও অধিকাংশই বিনামূল্যে। এসব হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের ভূমিকা প্রশংসার যোগ্য হলেও, গুরুতর আহতদের চিকিৎসা দিতে তাদের ব্যর্থতা আমাদের দেশের চিকিৎসা অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করেছে। এসব হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর গুরুতর আহতদের ঢাকার বড় হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হয়। ফলে, সেখানকার জরুরি বিভাগে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে।
এমন পরিস্থিতি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয় যে দেশের জরুরি চিকিৎসা সেবা কতটা অকার্যকর ও অপ্রস্তুত। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সীমিত সক্ষমতা, জরুরি বিভাগের অনভিজ্ঞ কর্মী এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, সবকিছু মিলিয়ে এই সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে। বিশেষ করে, দুর্ঘটনা ও অপ্রত্যাশিত ঘটনার সময় জনগণ যথাযথ সেবা না পেয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারাচ্ছে।
দেশের বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগের অবস্থা বেশ শোচনীয়। বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদের মতে, ৪৮০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগগুলো সক্ষমতা, লোকবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে ভুগছে। বেশিরভাগ হাসপাতালের ডাক্তাররা তরুণ ও কম অভিজ্ঞ এবং সরঞ্জাম ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশের অভাব তাদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে। ফলে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না, যা অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, হাসপাতালের কর্মীরা প্রায়ই রোগীর আত্মীয়দের সহিংসতার শিকার হন। বিশেষ করে রোগী মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা ‘মব জাস্টিস’ বা গণপ্রহারের মাধ্যমে তাদের ওপর চড়াও হয়। এর ফলে, চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে ইমার্জেন্সি রোগীদের বড় হাসপাতালে পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে। অনেক সময় গুরুতর রোগীদের সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়, কারণ স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচার করার মতো পর্যাপ্ত সুবিধা থাকে না।
এ সমস্যা শুধু বেসরকারি হাসপাতালগুলোরই নয়, বরং রাজধানীসহ দেশের বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলোকেও আক্রান্ত করেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং অন্যান্য বড় হাসপাতালগুলো, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো-সায়েন্স ও মুগদা হাসপাতালেও অভাব রয়েছে দক্ষ কর্মী এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের। যদিও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও অন্যান্য বড় হাসপাতালগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের সময় এই হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। তবুও, এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
জরুরি চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের জন্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। প্রথমত, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে জরুরি চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রতিটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। ‘মব জাস্টিস’ বা জনতাকর্তৃক সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য হাসপাতালগুলোতে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
জরুরি সেবার মানোন্নয়ন না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে যদি কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, যেমন ভূমিকম্প, তাহলে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের বিপর্যয়ের সময় কীভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে, কোথায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হবে, এবং কীভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে—এসব বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি এবং বেসরকারি উভয় হাসপাতালের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শিথিলতা মেনে নেওয়া যাবে না।
দেশের স্বাস্থ্য সেবা খাতের উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পরিবর্তে গুরুতর রোগীদের সেবা প্রদানে সক্ষম হতে হবে। এছাড়া, সবার জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসা কর্মী নিয়োগ এবং উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও জরুরি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের জীবন বাঁচানো এবং আহতদের সঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তবে এ জন্য সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ এবং সামাজিক সচেতনতা উভয়ই প্রয়োজন। একমাত্র সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার এই গুরুতর সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।