বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আর নেই। গত রোববার ৪ মে বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আরেক সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা ইউনিয়নের শেখলাল গ্রামে ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক প্রায় ৪৫ বছর আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি নিজেকে একজন দক্ষ ও পরিচিত আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। যুক্তরাজ্যের লিংকনস ইন থেকে ১৯৮০ সালে ব্যারিস্টার ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত লন্ডনে আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে এসে ধানমন্ডি ল’ কলেজে শিক্ষকতা ও আইন পেশায় যুক্ত হন। একই বছর তিনি হাইকোর্ট বিভাগে, ১৯৯৪ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯০ সালে গড়ে তোলেন নিজস্ব আইনি প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ল’ কাউন্সেল’। ২০০২ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পেশাগত জীবন ছিল বিস্তৃত ও ঘটনাবহুল। তিনি ইত্তেফাক ও একুশে টিভি মামলাসহ বিভিন্ন আলোচিত মামলার আইনজীবী ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদ সংক্রান্ত মামলা, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা এবং অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলা, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সংসদ সদস্য পদ বিষয়ক মামলাও পরিচালনা করেন। তবে তার সবচেয়ে বেশি পরিচিতি আসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের পক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে। তিনি আবদুল কাদের মোল্লা, অধ্যাপক গোলাম আযম ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পক্ষেও আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
তিনি আইন পেশার বাইরেও বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার রয়েছে একাধিক প্রকাশনা।
রাজনৈতিক জীবনেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। তিনি দীর্ঘ সময় জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার চলাকালে তিনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে থেকেই ২০১৫ সাল থেকে আইন পেশা পরিচালনা করতে থাকেন। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন। সে সময় জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি ডা. শফিকুর রহমান এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, “তার পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। তবে এটি যে কোনো সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমরা আশা করি, তার সঙ্গে আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।”
পরে তিনি ‘আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি’র প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সেই পদ থেকেও পদত্যাগ করেন।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, “আমি একজন আইনজীবী, কোর্ট রুম ব্যারিস্টার। আমি আইনের অঙ্গনে আমার অবদান রাখার চেষ্টা করবো। আইনের শাসন একটি অতি বড় জিনিস। দেশে যদি আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে আমাদের রাজনীতি সফল হবে অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। সুতরাং আইন অঙ্গনে আমার বিচরণ, আইন অঙ্গনে আমি থাকবো। আইন অঙ্গনের মাধ্যমেই আমি দেশ এবং জাতির খেদমত করার চেষ্টা করবো।”
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার দুই ছেলেই ব্যারিস্টার এবং সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় যুক্ত।
প্রবীণ এই আইনজীবীর মৃত্যুতে দেশের আইন অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো যেটি সহজে পূরণ হবার নয়। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তার অবদান ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।