নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের করার প্রবণতা আমাদের সমাজে দুঃখজনকভাবে বহু পুরোনো একটি সমস্যা। ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন-তখন এই অপপ্রবণতার আশ্রয় নেয়। বিশেষত, কোনো ব্যক্তি যদি তার ভাই বা আত্মীয়ের হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা করতে আসে, তখন দেখা যায় কিছু অসাধু আইনজীবী বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত একটি চক্র বাদীর অজান্তেই এজাহারে ১০০/২০০ জন নিরীহ ব্যক্তির নাম জুড়ে দেয়।
এভাবে গণহারে মানুষকে আসামি করার প্রবণতা শুধু বিচারপ্রার্থীর ন্যায্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না বরং তা বিচার ব্যবস্থার উপরও জনসাধারণের আস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, কিছু বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
১. আসামির নাম কর্তনের সুযোগ: যদি বাদী নিজেই এজাহারে উল্লিখিত কোনো ব্যক্তিকে তার আসামি নয় বলে দাবি করেন, তবে বিচারক যেন সিভিল মামলার মতোই নথি পর্যালোচনা করে সে নাম কর্তন করতে পারেন- এ ধরনের একটি আইনি সুযোগ থাকা উচিত। এতে নিরীহ মানুষের হয়রানি হ্রাস পাবে এবং মামলা আরও সুনির্দিষ্ট ও ন্যায্য হবে।
২. আইনজীবীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা: বাদীর সম্মতি ছাড়া গণহারে নাম জুড়ে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে বার কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ এনে তার লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও হওয়া উচিত।
৩. রাজনৈতিক মদদপুষ্ট চক্রের জবাবদিহিতা: গণবিরোধী মামলাবাজ চক্রকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও দুর্বল হবে।
৪. স্বাধীন তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন: একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পেশাদার তদন্ত সংস্থা গঠন করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়।
৫. অপরিকল্পিত আইন সংস্কার নয়: বিচারব্যবস্থায় গবেষণা, পর্যালোচনা ও বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ ছাড়া হঠাৎ কোনো বড় পরিবর্তন আনা উচিত নয়। এতে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি বরং বাড়তে পারে।
৬. আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করুন: আদালতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত আইনজীবীদের বেআইনি চাপ বন্ধ করতে হবে। বিচারক ও বিচারপ্রার্থী উভয়ের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব।
পরিশেষে, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে আমাদের বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পেশাদার রাখতে হবে। মিথ্যা মামলার নামে নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংস নয় বরং প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তিই হোক আমাদের লক্ষ্য। (লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
মোহাম্মদ জুনায়েদ
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট,
চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ঢাকা।