রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে, আর এ অবস্থায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক আর ক্ষোভ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। অতি সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে কয়েকটি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা নিরাপত্তা দাবি করে মোহাম্মদপুর থানার সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ এনে তাঁরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছেন।
শুক্রবার রাতেই মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় একটি সুপারশপে মুখোশ পরা সশস্ত্র ডাকাতেরা চাপাতি হাতে কর্মচারীদের জিম্মি করে টাকা লুট করে। মাত্র একদিন পরেই ২০ অক্টোবর সকালবেলা, মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় দুটি মোটরসাইকেলে ছয়জন সশস্ত্র ছিনতাইকারী একটি গাড়ি আটকিয়ে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা লুটে নেয়। এ ধরনের হামলায় স্থানীয় বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদপুরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো একে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। ঢাকার অপরাধ প্রবণ এলাকাগুলোর তালিকায় দীর্ঘদিন থেকেই মোহাম্মদপুর শীর্ষে রয়েছে, তবে অপরাধের পরিমাণ এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা অভাবনীয়।
গত ১১ অক্টোবর রাতের একটি ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেদিন রাত সোয়া তিনটার দিকে মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড়ে বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বকরের বাড়িতে হানা দেয় সশস্ত্র ডাকাতেরা। সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরা ওই দল নিজেদের যৌথ বাহিনী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বাড়ির মালিককে জিম্মি করে ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট করে। এ ঘটনার পেছনে র্যাবের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে অক্টোবর মাসেই মোহাম্মদপুর থানায় চারটি হত্যাকাণ্ড, একটি ছিনতাই এবং দুটি ডাকাতির মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসেও এই থানায় ১৭টি হত্যার অভিযোগ রেকর্ড করা হয়েছিল।
একটি ৫৬ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকায় এক তরুণীকে কয়েকজন ছিনতাইকারী টানাহেঁচড়া করে তাঁর ব্যাগ ছিনিয়ে নিচ্ছে। ঘটনাটি এলাকাবাসীর আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে গতকাল বিকেলে মোহাম্মদপুর থানার সামনে শতাধিক মানুষ জড়ো হয়ে পুলিশের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মুতাসিম বিল্লাহ স্থানীয় জনতার পক্ষ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান এবং পুলিশকে ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেন। তিনি বলেন, “এই সময়ের মধ্যে টহল কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, কিশোর গ্যাং ও অপরাধচক্রের দমন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, মোহাম্মদপুর থানার সামনে ছাত্র–জনতা অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে।”
অপরাধের এই বাড়বাড়ন্ত পরিস্থিতি নিয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন,
“মোহাম্মদপুর বরাবরই রাজধানীর অপরাধপ্রবণ একটি এলাকা। বিভিন্ন কারণে এখানে অপরাধ বাড়ছে। জনবল সংকটের কারণে আমরা ঠিকমতো টহল দিতে পারছি না।”
পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার জিয়াউল হক বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশে জনবল ও সরঞ্জামের সংকট দেখা দিয়েছে, যা টহল কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে।
এদিকে, র্যাব-২ এর পরিচালক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঁইয়া জানান, অপরাধের পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। অপরাধীদের ধরতে এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনী ব্লক রেইড পরিচালনা করছে বলে জানান তিনি।
মোহাম্মদপুরের অবনতি ঘটছে এবং এলাকাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংকট ও জনবল ঘাটতি দূর না হলে এবং টহল কার্যক্রম জোরদার না হলে অপরাধীদের ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ও স্থানীয় জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই একমাত্র সমাধান বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।