বাংলাদেশে ভারতীয় চোরাই পণ্যের আগ্রাসন বাড়ছে। বিশেষ করে শাড়ি, থান কাপড়, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি ও তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে। স্থল, নৌ ও আকাশপথ—এই তিন পথেই দেশে প্রবেশ করছে এসব অবৈধ পণ্য। দামি পণ্য আকাশপথে এবং তুলনামূলক কমদামি পণ্য স্থলপথে আসছে।
কখনো পাথরভর্তি ট্রাকে, কখনো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আবার কখনো বিপণিবিতানের কর্মীদের হাত ধরে এসব পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। ভারতীয় চোরাকারবারিরা সীমান্ত পার করলেই বাংলাদেশি চোরাকারবারিরা তা সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন মার্কেটে সরবরাহ করছে। এসব পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে, যা অর্থ পাচারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, প্রতিবছর প্রায় ৪৫০ কোটি ডলারের ভারতীয় কাপড় ও পোশাক চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা (এক ডলার ১২২ টাকা হিসেবে)। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে এবং দেশীয় তৈরি পোশাক খাতের ক্ষতি হচ্ছে। এনবিআরকে দেওয়া স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাচালান ও রাজস্ব ফাঁকিরোধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত থেকে স্থল, নৌ ও আকাশপথে এসব পণ্য বাংলাদেশে আসে। শুল্কমুক্ত বিভিন্ন পণ্যের চালানের মধ্যেও এসব অবৈধ কাপড় লুকিয়ে রাখা হয়। বিশেষ করে ভারতীয় যন্ত্রাংশবাহী কনটেইনারের সঙ্গে লুকিয়ে এই কাপড় আসে। ভারতের আহমেদাবাদ ও কলকাতা—এই দুই শহর থেকেই চোরাচালান করা হয়। আহমেদাবাদ থেকে প্রথমে করিমগঞ্জ ও আগরতলা হয়ে এসব পণ্য নৌ ও স্থলপথে সিলেট, ফেনী, ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কলকাতা থেকে সরাসরি বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে প্রবেশ করে এসব পণ্য দেশের বিভিন্ন মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে।
আকাশপথে চোরাচালান আরও সুসংগঠিতভাবে চলে। কলকাতা থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে এসব শাড়ি ও পোশাক আমদানি হয়। এসব পণ্য বিমানযাত্রীদের অতিরিক্ত লাগেজ হিসেবে আনা হয়, যা পুরোপুরি অবৈধ না হলেও চোরাচালানের একটি বড় মাধ্যম। ব্যবসায়ীরা ভারত গিয়ে পছন্দের পণ্যের নমুনা দেখেন, এরপর এজেন্টদের মাধ্যমে তা বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়। এসব পণ্যের লেনদেন হয় মূলত হুন্ডির মাধ্যমে।
দেশের বিপণিবিতানগুলোয় প্রতিনিয়ত ভারতীয় শাড়ি বিক্রি হয়, অথচ এসবের সিংহভাগই অবৈধভাবে আসে। বৈধ পথে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাত্র ৩৪ কোটি ৪০ লাখ, ২০২০-২১ সালে ৫৯ কোটি ২৬ লাখ, ২০২১-২২ সালে ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ, ২০২২-২৩ সালে ৫৮ কোটি ৫৫ লাখ এবং ২০২৩-২৪ সালে ৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকার শাড়ি আমদানি হয়েছে। কিন্তু অবৈধ পথে এর কয়েক গুণ বেশি শাড়ি দেশে প্রবেশ করেছে।
সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারি চক্র শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় কাপড় ও পোশাক এনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে। ঈদ ও পূজার মৌসুমে এদের তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। অনেকে দোকানের কর্মচারীদের পাসপোর্ট করিয়ে তাদের মাসে একাধিকবার ভারতে পাঠান। সেখানে তারা কাপড় ভর্তি লাগেজ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এভাবেই প্রতিদিন প্রচুর ভারতীয় পোশাক বাজারে আসছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতীয় চোরাই পোশাকের কারণে দেশীয় ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছেন। স্থানীয় বাজারে এসব সস্তা পোশাক ঢুকে পড়ায় অনেক দেশীয় কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ফলে শ্রমিকরা বেকার হচ্ছেন। এর ফলে দেশের বিনিয়োগও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
চোরাচালানের মাধ্যমে আমদানি হওয়া এসব পোশাকের পেমেন্ট মূলত হুন্ডির মাধ্যমে হয় যা অর্থ পাচারের অন্যতম মাধ্যম। অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের প্রকৃত মূল্য কম দেখিয়ে অবৈধভাবে বেশি দামের পণ্য আনা হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে চোরাচালান রোধে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে—
১. সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহল বৃদ্ধি করা।
২. বন্দরগুলোতে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা ও আন্ডার ইনভয়েসিং প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
৩. কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং উচ্চ আদালতে রিটের দ্রুত নিষ্পত্তি করে নতুন বিধিমালা কার্যকর করা।
চোরাচালানের এই বিশাল নেটওয়ার্ক বন্ধ না করা গেলে দেশীয় শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং রাজস্ব ঘাটতি আরো বাড়বে। এখন প্রয়োজন কঠোর মনিটরিং ও কার্যকর আইন প্রয়োগ যাতে চোরাচালান বন্ধ করে দেশের বৈধ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করা যায়।