ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও দেশের শীর্ষ ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ অর্থনৈতিক অনিয়ম, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার ও ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ তদন্ত করছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত ১১টি যৌথ তদন্ত দল। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ধরনের অনিয়ম ও বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার তথ্য পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে একাধিক মামলাও দায়ের হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে একটি বিশেষ অধ্যাদেশ তৈরির কাজ চলছে, যার আওতায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় বিদেশি সম্পদ জব্দ ও উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তদন্তে সহায়তা করছে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে গঠিত মানি লন্ডারিংবিরোধী বিশেষজ্ঞ দল। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর নেতৃত্বে সিআইডি, এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বয়ে তদন্ত চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ নিরাপত্তাবেষ্টিত কক্ষে এসব তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তের নথি প্রস্তুত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের পাশাপাশি যেসব শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, তাদের মধ্যে রয়েছে—এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, বসুন্ধরা, সিকদার ও আরামিট গ্রুপ। এদের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণ, খেলাপি ঋণ, বিদেশে অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও ঘুষ-দুর্নীতির নানা তথ্য মিলেছে। অনেক গ্রুপের প্রধানরা বাংলাদেশের নাগরিকত্বও ত্যাগ করেছেন।
এ বিষয়ে প্রতি মাসেই পর্যালোচনা সভা করছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগামী ১৬ এপ্রিল ফের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ–সংক্রান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে আজ (১৩ এপ্রিল) পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার টাস্কফোর্সের সভা হচ্ছে, যার প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নর মনসুর চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, দেশে থেকে বিদেশে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যার মধ্যে শুধু বেক্সিমকো গ্রুপেরই প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। তিনি জানান, ছয় মাসের মধ্যে এই পাচারকৃত অর্থের একটি বড় অংশ জব্দ করা হবে এবং সেই লক্ষ্যে বিদেশি আইন সংস্থা ও ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।
তদন্তে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম পাওয়া গেছে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে। তারা ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, এসআইবিএল, গ্লোবাল, ইউনিয়ন, জনতা ও এক্সিমসহ ১১টি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছে। অনেক ঋণ ইতোমধ্যেই খেলাপি হয়েছে এবং এ অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। ছয়টি দেশে তাদের মালিকানাধীন তারকা হোটেল, জমি ও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে।
আরামিট গ্রুপ এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের নামে যুক্তরাজ্য, ইউএই ও যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশে-বিদেশে মোট ৫৮০টি বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও জমি রয়েছে, যেগুলো আদালতের আদেশে জব্দ করা হয়েছে। বেসরকারি ইউসিবি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও ছিল এই পরিবারের হাতে।
বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক সালমান এফ রহমানের কোম্পানিগুলোর মোট ঋণ ছাড়িয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। তদন্তে উঠে এসেছে লন্ডন ও সিঙ্গাপুরে তাদের পরিবারের নামে গড়ে তোলা সম্পদের তথ্য।
বসুন্ধরা গ্রুপের নামে রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ, যার একটি অংশ ইতোমধ্যে খেলাপি হয়েছে। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানসহ তাঁর পরিবারের আট সদস্যের বিদেশি সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তাদের সম্পদের অবস্থান সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্লোভাকিয়া, সাইপ্রাস, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে। এসব দেশের আদালতে মামলার মাধ্যমে সম্পদ জব্দের উদ্যোগ চলছে।
সিকদার গ্রুপও ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছে। তাদের সম্পদ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক, লাস ভেগাস, আবুধাবি ও ব্যাংককে। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডে রয়েছে তাদের একাধিক কোম্পানি।
ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের ৩১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ ও ৪৩ একর জমি জব্দ করা হয়েছে। নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের যুক্তরাজ্যে পাঁচটি বাড়ি, আইলে অফ ম্যানে একটি ও জার্সিতে একটি বাড়ির সন্ধান মিলেছে, যেগুলো অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
নাবিল গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ সরিয়েছে। সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খানসহ পরিবারের ১১ সদস্যের ১৯১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা, টিউলিপ সিদ্দিকসহ পরিবারের ছয় সদস্য এবং একাধিক রাজউক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পূর্বাচলে বেআইনিভাবে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। টিউলিপের যুক্তরাজ্যে একাধিক ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে জেমকন গ্রুপের বিরুদ্ধে বড় কোনো অনিয়মের প্রমাণ মেলেনি।
এই ব্যাপারে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, অর্থ পাচার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তদন্ত চললেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বাস্তব পদক্ষেপ ছাড়া বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন সম্ভব নয়। অর্থ ফেরত আনা কঠিন হলেও ভবিষ্যতে যেন কেউ পাচার করতে না পারে সেটাই সবচেয়ে জরুরি।
সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, পাচার রোধে নেওয়া উদ্যোগের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে অর্থ পাচারের হার কমেছে। এর প্রভাব ইতিবাচকভাবে পড়েছে প্রবাসী আয়েও। এই প্রক্রিয়াকে বর্তমান সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর একথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, যারা অর্থ পাচার করেছে তাদের জীবন কঠিন করে তোলা হবে—যাতে কেউ ভবিষ্যতে এমন অপরাধ করার সাহস না পায়।
এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি ও সুশাসনের প্রশ্নে অর্থপাচার, কর ফাঁকি ও ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির তদন্ত কার্যক্রম শুধু আর্থিক পুনরুদ্ধারের প্রশ্নই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার পরীক্ষাও হয়ে উঠেছে। এখন দেখার বিষয়, এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে এবং বিদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার কঠিন প্রক্রিয়াটি কতটা বাস্তবায়ন হয়