সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক নিয়োগ অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় সাবেক উপাচার্যসহ ৫৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নিয়োগ-বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারের বিপুল অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দীর্ঘ তদন্ত শেষে এই অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়।
সোমবার (২১ এপ্রিল) সিলেট দুদকের আদালত পরিদর্শক মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, রোববার দুপুরে সিলেট মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রোকনুজ্জামানের কাছে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. ইসমাইল হোসাইন। তিনি জানান, নিয়োগবিধি না মেনে, যোগ্যতা ও বয়সের সীমা উপেক্ষা করে, কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই যাদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে—তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
এ মামলায় যাঁরা অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী, সাবেক ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. নঈমুল হক চৌধুরী, উপপরিচালক (পরিবহন ও উন্নয়ন) ফাহিমা খানম চৌধুরী, সহকারী রেজিস্ট্রার অঞ্জন দেবনাথ, সহকারী কলেজ পরিদর্শক মাইদুল ইসলাম চৌধুরী, সহকারী পরিচালক (পরিবহন ও উন্নয়ন) মো. গোলাম সরোয়ার, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বিলাল আহমদ চৌধুরী, সহকারী পরিচালক (বাজেট) শমসের রাসেল এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী মো. ফারাজসহ মোট ৫৮ জন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি ও আইনগত অনুমোদন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে ২২০ জনকে অস্থায়ীভাবে (অ্যাডহক) নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়িয়ে তাদের অনেককে নিয়মিত না করেই কয়েক দফায় চাকরিতে বহাল রাখা হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থী। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৮-এর ১২(১০) উপধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, অ্যাডহক নিয়োগ সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য দেওয়া যাবে, এবং প্রয়োজনে একবার ছয় মাস বাড়ানো যাবে। এরপর হয় নিয়োগ নিয়মিত করতে হবে, না হলে অব্যাহতি দিতে হবে।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুমোদিত সংখ্যা ছিল ১১২, কিন্তু বাস্তবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৩৯ জনকে। ইউজিসি অনুমোদনপ্রাপ্ত ৯৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া বাকি অতিরিক্ত ১৪১ জনের জন্য neither স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় nor ইউজিসির কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এতে প্রমাণিত হয়, কর্তৃপক্ষ নিয়ম না মেনে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অতিরিক্ত নিয়োগ দিয়েছে এবং সরকারের ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বেশি বেতন-ভাতা বাবদ অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ওই ৫৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৪৬ জনের বয়সজনিত যোগ্যতা না থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৮ জনের কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না, চারজন ছিলেন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন, অথচ তাদেরও নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার তিনজনকে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার পরও তাদের নবম গ্রেডে উন্নীত করা হয় এবং সাতজনকে ১৪তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এমনকি দুইজন কর্মকর্তার নির্দিষ্ট পদে প্রয়োজনীয় ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী এবং ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ) নঈমুল হক চৌধুরী। শুরু থেকেই জনবল কাঠামোর বাইরে নিয়োগ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে ইউজিসি। ইউজিসির তদন্তেও একই ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। পরবর্তীতে সেই অনুসন্ধানের ভিত্তিতেই মামলা দায়ের করে দুদক।
দুদকের অভিযোগপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এসব নিয়োগে কোনো বিধিমালার তোয়াক্কা করা হয়নি এবং পুরো প্রক্রিয়াই ছিল অসৎ উদ্দেশ্যপ্রসূত। অভিযুক্তরা ব্যক্তিগত ও অন্যদের আর্থিকভাবে লাভবান করার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, যা দণ্ডবিধি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালতে দাখিলকৃত এই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে মামলার বিচার শুরু হলে দেশের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগ ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়েও বড় ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।