রাজধানীর অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০০৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অন্তত ৯ হাজার ২১৪ জন শিক্ষার্থীকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন গভর্নিং বডির কিছু সদস্য, অধ্যক্ষ, শাখা প্রধান, কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতাদের একটি চক্র প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে ২০০৯, ২০১০ ও ২০১৩ সালের গুরুত্বপূর্ণ নথি লোপাট হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ভর্তি বাণিজ্য হয়েছে প্রথম শ্রেণিতে। দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণিতেও নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। নবম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষার মেধাতালিকা না মেনে ভর্তি করা হয়েছে। এসব ভর্তি সাধারণত জানুয়ারি মাসে হওয়ার কথা থাকলেও এগুলো সম্পন্ন হয়েছে গোপনে মার্চ থেকে জুনের মধ্যে।
২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এবং ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে মতিঝিল, বনশ্রী ও মুগদা শাখায় অনুমোদিত আসনের চেয়ে ৩৮০২ জন বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে ২৭৮৩ জন ছিল অতিরিক্ত, ৮৬৬ জন ভর্তির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ভুয়া ট্রান্সফার সার্টিফিকেট (টিসি), ৩৬ জন ভর্তি হয়েছেন ‘বিশেষ বিবেচনায়’, আর চলতি বছরে সহোদর কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ১১৭ জন। ২০১১ সালে ২৯০০ এবং ২০১২ সালে ১৯৫৬ জন শিক্ষার্থীকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি করা হয়েছে।
২০১৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে অনলাইন লটারি চালু হওয়ার ঘোষণার পর ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ২২৩৫ জন শিক্ষার্থী নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি হয়। ওই সময় গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার তিন বছরের মেয়াদে ২৩৬৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য পাওয়া গেছে। আলোচিত সাবেক সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের সময়ে ২৯০ শিক্ষার্থী এভাবে ভর্তি হন।
টিসির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট রেকর্ড নেই। মতিঝিল শাখার বাংলা ভার্সনে ২৫৮ জন, ইংরেজি ভার্সনে ২০৯ জন, বনশ্রী শাখায় বাংলা ভার্সনে ২২১ এবং ইংরেজি ভার্সনে ৭২ জন, মুগদা শাখায় ১০৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য মিলেছে।
২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী না ভরতি করেও ভিন্ন কৌশলে বাণিজ্য চলেছে। ২০২৩ সালে ৩৫০ জন এবং ২০২৪ সালে ১৫০ জন শিক্ষার্থী বয়সজনিত জটিলতা বা বাতিল হওয়া সহোদর কোটার সুযোগ নিয়ে ভর্তির সুযোগ পান। ২০২৪ সালে আদালতের রায় দেখিয়ে ভাইবোন কোটায় ভর্তি করানো হয় ৩০ জনকে। চক্রটি অভিভাবকদের রায় আনতে পরামর্শ দিত এবং আপিল না করে ভর্তি সম্পন্ন করত। এ বছর বদলি কোটা দেখিয়ে আরও ৬৮টি ভর্তির অভিযোগ রয়েছে।
ভর্তিপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল তিনটি শাখার ১২ জন শাখা প্রধান। তারা বছরে দুজন থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী ভর্তির কোটা পেতেন। তবে শেষ অধ্যক্ষ ইমাম হোসেন শাখা প্রধান থাকাকালে কোটা নেননি। ২০২১ সালের একটি নথিতে আট শিক্ষার্থীকে এমন কোটা থেকে ভর্তি করার তথ্য মিলেছে। চলতি বছর ভর্তিতে সুযোগ না দেওয়ায় ইমাম হোসেনকে ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
২০১১ ও ২০১২ সালেও বড় ধরনের জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু ২০১১ সালেই ২৯০০ শিক্ষার্থীকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে ভর্তি করা হয়। সবমিলিয়ে, নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রতি শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
কালবেলার অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, এসব অনিয়মের সময় দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ ছিলেন ড. শাহান আরা বেগম। তাকে সহযোগিতা করতেন বহিষ্কৃত উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান। তারা বনশ্রীতে একটি বেসরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে শাহান আরা অধ্যক্ষ। আতিক ও শাহান আরার ছেলে গড়ে তুলেছেন ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। দুদকের তদন্তে আতিকের বিরুদ্ধে আড়াই কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ৪৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এ ঘটনায় গত ৬ এপ্রিল দুদক অধ্যক্ষ শাহান আরা, সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক শহীদুল ইসলামসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
অনিয়ম খতিয়ে দেখতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্য সচিব শওকত হোসেন মোল্লা জানান, তারা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠান থেকে ভর্তি সংক্রান্ত নথি চেয়েছেন। এর আগে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর রাজনৈতিক চাপে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিগত বছরগুলোয় আইডিয়ালে ৯টি গভর্নিং বডি ছিল যার মধ্যে মাত্র তিনটি ছিল নিয়মিত। বাকি ছয়টি অ্যাডহক বা বিশেষ কমিটি হিসেবে গঠিত হয়েছিল যাদের সময়েই ভর্তি বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে। সভাপতি ছিলেন রাশেদ খান মেনন, আবু হেনা মোরশেদ জামান ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোল্লা জালাল উদ্দিন ও জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান যাঁরা ছয় মাস করে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সুপারিশে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি করা হতো। সুপারিশকারীদের মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক তিন সচিব, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, জনপ্রশাসন মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, দুদক চেয়ারম্যান, বিমানের চেয়ারম্যান, শিক্ষা সচিবসহ অন্তত দুই ডজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। ২০২১ সালে এসব সুপারিশে ১৪১ জন ভর্তি হন যাদের অনেকের পক্ষে কোনো সুপারিশপত্রও ছিল না। তৎকালীন জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলামের নাম ব্যবহার করে ১৪ জনকে ভর্তি করা হয়। দুদকের মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।
নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষাবোর্ড বা অধিদপ্তরের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ভর্তির রেজিস্ট্রারে গরমিল রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই প্রতিবছর আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফেরদাউস কালবেলাকে বলেন, ‘আমি গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়েছি। এর আগের ঘটনার দায় আমি জানি না। আমরা আইনজীবী নিয়োগ করে এসব রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করছি।’
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু কালবেলাকে বলেন, ‘এটি ছিল শিক্ষক, গভর্নিং বডি ও রাজনৈতিক নেতাদের একটি সিন্ডিকেটের কাজ। তারা নিজেরাই সুপারিশ সংগ্রহ করে দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি। গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান না থাকায় এ অনিয়ম বারবার ঘটছে।’
সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম, সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান এবং কর্মকর্তা আতিকুর রহমান খানের সঙ্গে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ছাত্র হত্যা মামলায় কারাবন্দি রাশেদ খান মেননের সঙ্গেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
এই ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তদন্তে প্রমাণিত হলে এটি হবে দেশের অন্যতম বড় শিক্ষাবাণিজ্য কেলেঙ্কারি।