দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স কমিউনিকেশনের বিরুদ্ধে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি দেশের ব্যান্ডউইথ নিরাপত্তার ওপরও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রভাব খাটিয়ে লাইসেন্সও নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সরকারি নিয়মকানুনের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স একে একে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট-টেলিকম লাইসেন্স দখল করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আইআইজি, আইটিসি, আইজিডব্লিউসহ আরও কয়েকটি লাইসেন্স। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই লাইসেন্স পাওয়ার পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক সুবিধা।
সূত্র ও নথি যাচাইয়ে জানা গেছে, ওয়ান এশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের শীর্ষ ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি সংস্থার কাছে বকেয়া রেখেছে কোটি কোটি টাকা। বিটিআরসির কাছে তাদের প্রায় চার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিপিএল) তাদের কাছে এক কোটি টাকার বেশি পাওনা দাবি করেছে। টেলিকম জায়ান্ট এয়ারটেল এবং টাটাও যথাক্রমে ১৩ কোটি ও ৫ কোটি টাকা বকেয়া দাবি করেছে।
বকেয়া আদায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা চেষ্টা করেছে। তবুও সাফল্য মেলেনি। তাই বিএসসিপিএলসি ঢাকার জেলা জজ আদালতে ‘আরবিট্রেশন মামলা’ দায়ের করেছে। মামলা তারা জিতেছে। এরপর ‘অ্যাওয়ার্ড এক্সিকিউশন মামলা’ করা হয়, যা এখনো চলমান। তদন্তে জানা গেছে, ওয়ান এশিয়ার মালিকরা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে চাপ প্রয়োগ করছেন, যেন তাদের লাইসেন্স বাতিল না হয় এবং ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে। নিয়মবহির্ভূতভাবে তারা এনওসিও নিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স প্রথমে আইআইজি, আইটিসি ও আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিয়ে টেলিকম খাতে প্রবেশ করেছিল। পরে তারা শর্ত লঙ্ঘন করে একাধিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। তাদের মালিকানাধীন বেঙ্গল ব্রডব্যান্ড ২০১৬ সালে ডিভিশনাল আইএসপি লাইসেন্স পেয়েছিল। তবে নবায়ন না করেই অবৈধভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে। তাদের মালিকানাধীন প্রিজমা ডিজিটাল নেটওয়ার্কের ন্যাশন ওয়াইড আইএসপি লাইসেন্স রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেননি। দেখা গেছে, বেঙ্গল কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসফারিয়া খায়ের প্রতিবেদকের নম্বর ব্লক করে দিয়েছেন।
বিটিআরসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্সকে মোট বকেয়ার অর্ধেক এককালীন পরিশোধ এবং বাকি কিস্তিতে দেয়ার শর্তে এনওসি দেওয়া হয়েছে। তবে নির্ধারিত ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে তারা মাত্র এক কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, আইএসপি সেক্টরের সেবা আইআইজি ও ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভর করে। কেউ যদি কোটি কোটি টাকা বকেয়া রেখে অনিয়ম করে, তাহলে গ্রাহকদের নিরাপত্তা ও সংযোগে ঝুঁকি বাড়ে। তবে এর পেছনে যদি কোনো নীতিগত বা কাঠামোগত সমস্যা থাকে, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিয়ম অনুযায়ী পর্যালোচনা জরুরি। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বকেয়া বা নীতিগত অনিয়মে জড়িত থাকে, তা ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাধান হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলাম হোসেন জানান, অনেকবার দাবী জানিয়ে তাগাদা দিলেও প্রতিষ্ঠানটি পাওনা পরিশোধ করেনি। চিঠির জবাবও দেয়নি। এখন তাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে মামলা করতে হয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব বলেন, আমরা চাই ব্যবসায়ীরা স্বচ্ছন্দে ব্যবসা করুক। গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করুক। তবে সরকারের পাওনা না দিয়ে কেউ অনিয়ম করলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের এই পরিস্থিতি বড় ধরনের সতর্কবার্তা। সরকারি সংস্থাগুলোকে কঠোর ও স্বচ্ছ নীতিমালা মেনে কাজ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হতে হবে। এভাবে ব্যবসা করলে দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং গ্রাহক সেবা দুটোই হুমকির মুখে পড়বে।