আগামী আমন মৌসুমে দেশে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত বছর বোরো মৌসুমে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এর মধ্যে সার বিতরণে চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সারের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ইউরিয়া সার সরবরাহের এই দুর্বল চেইনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনলে এবারও কৃষকরা সময়মতো প্রয়োজনীয় সার পাবে না। এ শঙ্কা মাথায় রেখে অন্তর্বর্তী সরকার আমন মৌসুম নির্বিঘ্ন করতে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে।
তথ্য অনুযায়ী, সরকার ভর্তুকি দিয়ে যে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার আমদানি করে তা পরিবহনের দায়িত্বে থাকা কিছু ঠিকাদার বছরের পর বছর ধরে আত্মসাত করে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ঠিকাদার নিয়োগে জালিয়াতি, অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রতি বছরই ঘটছে সার কেলেঙ্কারি। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)-এর কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় বারবার অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ পরিবহন ঠিকাদারদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে দেশের সার সরবরাহব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে।
বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রোটন ট্রেডার্সের মালিক সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান প্রোটন, নবাব অ্যান্ড কোং-এর মালিক মো. নবাব খান এবং কুষ্টিয়া ট্রেডিং এজেন্সির মালিক মোখলেছুর রহমানের মতো ব্যক্তিরা প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন সরকারি সার আত্মসাত করেন। যার আমদানি মূল্য প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এসব ঘটনায় নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বর্তমানে কৃষকরা সময়মতো সার পাবে কি না।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার জিটুজি (সরকার-টু-সরকার) পদ্ধতিতে যে সার আমদানি করে তার পরিবহন চুক্তি দেয় বিএসসি। কিন্তু এই সংস্থার দায়িত্বহীনতার কারণেই প্রতি বছর নিয়োগ পাচ্ছে অপেশাদার পরিবহন ঠিকাদাররা, যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সার পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, জাহাজ পরিবহনের দরপত্র মূল্যায়নের সময় অনেকেই জাল অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিলেও সেগুলো যাচাই-বাছাই না করেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়। বিএসসির চার্টারিং অ্যান্ড ট্রাম্পিং বিভাগের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় এসব অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলেছে।
বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে স্বদেশ শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিক কোং, সামিট অ্যাসোসিয়েশন ও ইন্টার ওশান। অভিযোগ অনুযায়ী, এসব ঠিকাদার বছরের পর বছর ধরে আমদানিকৃত সার সঠিকভাবে পরিবহন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের নিজস্ব কোনো কার্যকর পরিবহন ব্যবস্থা নেই ফলে সার গুদামে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে এবং কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিকভাবে কম দামে দরপত্র দিচ্ছে যা সেবা প্রদানে সংকট সৃষ্টি করছে।
সম্প্রতি বিসিআইসি ৩০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করে। সাধারণত এক মেট্রিক টন ইউরিয়া পরিবহনে সব খরচ মিলিয়ে ৫০ থেকে ৫২ ডলার লাগে। কিন্তু এবার কিছু প্রতিষ্ঠান ৬ থেকে ৮ ডলার কমে দরপত্র জমা দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই কম দরে কাজ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো গুণগত মান এবং সময়সীমা রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে যার প্রভাব পড়বে সরবরাহ ব্যবস্থায়। ফলে কৃষকের জন্য সঠিক সময়ে সার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
একজন জাহাজ পরিবহন বিশ্লেষক বলেন, কেউ যদি ৫০ ডলারের জায়গায় ৪৪ ডলারে কাজ করতে চায়, তাহলে সেই সেবার মান ও সময়সীমা সন্দেহজনক হয়ে যায়। সরকার হয়তো এটিকে ব্যয়সাশ্রয়ী ভাবতে পারে, কিন্তু এর পেছনে থাকে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সারের চোরাচালান। এর মূল্য দিতে হয় দেশের কৃষককে আর লাভবান হয় কিছু সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেককে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমার কাছে এখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে, সামিট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মো. ফরিদ হোসেন প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে শুরুতে নিজের পরিচয় অস্বীকার করেন। পরে তিনি নিজের নাম ও পদ স্বীকার করে জানান, প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু তদারকি করেন আরেক পরিচালক ওবায়েদুর রহমান যিনি বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন।
স্বদেশ শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিক কোম্পানির পরিচালক মো. সুমনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করে বারবার সংযোগ কেটে দেন। পরে তার জেনারেল ম্যানেজার ইফাদ জিকু জানান, “মালিকের সঙ্গে কথা বলে রাত ১২টার পর জানাব।”
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের সার সরবরাহ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কৃষকরা মৌসুমে প্রয়োজনীয় সার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই চক্র ভাঙা না গেলে ভবিষ্যতেও কৃষি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যা জাতীয় উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।