কুমিল্লা শহর। এক সময়ের ক্রীড়াপ্রেমী, বিসিবি সভাপতি, আইসিসির শীর্ষ পদে থাকা মানুষটি এখন আলোচনায় এক ভিন্ন পরিচয়ে। তিনি আহম মুস্তফা কামাল, যিনি লোটাস কামাল নামেই বেশি পরিচিত। তবে তাঁর পরিচিতি এখন রাজনীতি কিংবা ক্রিকেট নয়—বরং দুর্নীতির অলরাউন্ড পারফরম্যান্স।
একদিকে ক্রিকেট মাঠে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা, অন্যদিকে অর্থনীতির মাঠে দুর্নীতির একের পর এক ইনিংস। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট থেকে পাঁচবারের সংসদ সদস্য। ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী, এরপর অর্থমন্ত্রী। অথচ ঠিক তাঁর হাত ধরেই দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে।
মন্ত্রী হয়ে বলেছিলেন—“খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না।” বাস্তবে হলো উল্টোটা। খেলাপি ঋণ রেকর্ড গড়ল। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি institutionalized হয়ে গেল। এস আলম গ্রুপের হাতে একে একে তুলে দিলেন ৯টি ব্যাংক। ব্যাংকের এমডি নিয়োগ থেকে শুরু করে পরিচালনা পর্ষদে ঘুষের খেলা চলল প্রকাশ্যে। যেকোনো ঋণ অনুমোদন, চেয়ারম্যান নিয়োগ—সব জায়গায় লুটের নীতিমালাই ছিল একমাত্র মানদণ্ড।
তাঁর ছায়া হিসেবে কাজ করতেন এপিএস কে এম সিংহ রতন। যিনি পরিণত হন আর্থিক খাতের ছায়ামন্ত্রীতে। বদলি, নিয়োগ, পদোন্নতির কমিশন দিতেই হতো। ভাই গোলাম সারওয়ারের মাধ্যমে কবজায় রাখতেন কুমিল্লার দলীয় নিয়ন্ত্রণ। শুধু অর্থনীতি নয়—রাজনীতিতেও ছিল স্বজনপ্রীতির রাজত্ব।
২০১৪ সালের পরে রাজনীতিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়া যেন তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের সংজ্ঞা হয়ে ওঠে। সেই সময় থেকে এলাকাবাসী দেখেছেন কেবল প্রকল্পভিত্তিক লুটপাটের কৌশল। যেমন, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার প্রকল্প—যেটি ছিল নিজের এলাকায় করার জন্য জোর খাটিয়ে নেয়া একটি সিদ্ধান্ত। পরবর্তীতে ওই প্রকল্পে কাজের চেয়ে সিন্ডিকেটের কমিশনই বেশি গুরুত্ব পায়।
আরেকটি প্রকল্প—নলেজ পার্ক। প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা খরচ হলেও বাস্তবে সীমানাদেয়াল ছাড়া কিছুই হয়নি। অথচ জমি অধিগ্রহণ, নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ—সব কিছুতেই ছিল লোটাস সিন্ডিকেটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। প্রকল্প ছিল লুটপাটের মাধ্যম, জনগণের উন্নয়ন নয়।
খাল খননের নামে বরাদ্দকৃত প্রায় ২০ কোটি টাকা সরাসরি আত্মসাৎ করেছে তাঁর লোকজন—এমন অভিযোগও রয়েছে। আর এসব তথ্য আদালতে মামলার রূপ নিয়েছে ২০২৩ সালের অক্টোবরে।
তাঁর হলফনামায় দেখা যায়, স্ত্রী কাশমেরী কামালের সম্পদের পরিমাণ স্বামীর তুলনায় অনেক বেশি। সাকুল্যে তাদের দেখানো অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। অথচ বাস্তবে লোটাস কামালের সম্পদ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষ করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সময় তিনি ছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। মেয়ে নাফিসা কামালের নামে এবং স্ত্রী ও নাতনিদের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ দান করেছেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এই সম্পদ কোথা থেকে এলো, তার জবাব নেই।
এতসব অভিযোগের মধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ প্রকল্প আরেক নজির। যেখানে অনুমোদনের আগেই তাঁর ভাই সস্তায় জমি কিনে পরে চড়া দামে বিক্রি করেছেন সরকারকে। এ প্রকল্প থেকে অন্তত ২০০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দলীয় রাজনীতিতেও নিজের ইচ্ছামতো নিয়োগ দিয়েছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগেও চলে ঘুষ বাণিজ্য। জনপ্রতি লাখ লাখ টাকার দর হাঁকা হতো এসব পদে।
লোটাস কামালের ঘনিষ্ঠরা এখন বিদেশে। ভাই গোলাম সারওয়ার জুনে কানাডা গেছেন—আর ফেরেননি। এরই মধ্যে নানা জায়গায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।
লোটাস কামাল ছিলেন এক জন ‘অলরাউন্ডার’। কিন্তু সেটা দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করার ক্ষেত্রে নয়—বরং দুর্নীতির প্রতিটি স্তরে তাঁর অবাধ বিচরণ। ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, প্রকল্প বাণিজ্য এবং আর্থিক খাতের লুটপাটে তিনি একক প্রভাবশালী চরিত্র। তাঁর শাসনামলে ব্যাংকিং খাত যেমন জর্জরিত হয়েছে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে।
একজন অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে দেশ কী আশা করে? স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত। কিন্তু কামালের সময়টা পরিণত হয় লুটপাট আর দুর্নীতির নিয়মিত আখ্যান হয়ে। দেশের অর্থনীতি আজ যেখানে, সেখানে এই ভূমিকা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই।