দীর্ঘদিন দস্যুমুক্ত থাকার পর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পাঁচটি দস্যু বাহিনী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্যটির বিভিন্ন অঞ্চলে এখন জেলেরা জিম্মি হয়ে পড়ছেন তাদের হাতে। অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করছে দস্যুরা, না দিলে মিলছে হত্যার হুমকি।
অনেকে বাধ্য হয়ে মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করছেন। চাঁদা না দিলে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন জেলেরা। কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের তথ্যমতে, দেশি-বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে করিম শরীফ, দয়াল, দুলাভাই, মামা-ভাগিনা ও কাজল-রনি বাহিনী। গত ছয় মাসে কোস্ট গার্ডের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে এসব বাহিনীর অন্তত ৩০ সদস্য। উদ্ধার করা হয়েছে ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৩০৮টি গুলি ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। অপহৃত ৩৩ জন জেলে, যাদের মধ্যে নারীও ছিল, তাদের উদ্ধার করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানায় হামলার সময় কারাবন্দি অনেক দস্যু পালিয়ে যায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় নতুন ও পুরনো দস্যুরা একত্র হয়ে গড়ে তোলে এসব বাহিনী। বর্তমানে প্রতিটি বাহিনীতে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। সুন্দরবনের চকপাড়া বাজার, মল্লাখালী, ঝাপসি, কামারখোলা, আদাচাইসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে তাদের আস্তানা।
দয়াল বাহিনী নামের একটি গোষ্ঠী দস্যুতার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য মজনু বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করে। সূত্র জানায়, ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে গত এপ্রিলে দয়াল বাহিনী সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। মজনু বাহিনী ইতিমধ্যে ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তান্তর করে তারা দেশত্যাগ করে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ, রমজাননগর, কৈখালী ও ঈশ্বরীপুর এলাকায় দয়াল বাহিনীর দাপট বেশি। জেলেদের কাছ থেকে নৌকাপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছে তারা। না দিলে চলছে নির্যাতন।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জালাল হোসেন বলেন, অনেক বছর সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ছিল। জেলেরা নিরাপদে মাছ ধরতেন। কিন্তু নতুন করে দস্যুদের আবির্ভাবে জেলেরা এখন আতঙ্কে। সম্প্রতি দক্ষিণ কাইনমাড়ির নাথন নামের এক জেলেকে গভীর সমুদ্র থেকে অপহরণ করে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। পরিবারটি এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।
মোংলার চিলা ইউনিয়নের জেলে চিত্ত মণ্ডল জানান, দুবলার চরে মাছ ধরতে গিয়ে দস্যুদের হাতে কয়েকজন জেলে অপহৃত হন। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলেও পুরো সময় আতঙ্কে ছিলেন তারা। শত শত জেলে পরিবার এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
২০১২ সালে র্যাবের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে অভিযান চালায়। ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২৩টি অভিযানে ১৩৫ দস্যু নিহত ও ৫০০ জন গ্রেপ্তার হয়। ২০১৬ সালে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দস্যু দমন কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ৩২টি বাহিনীর ৩২৪ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। সরকার ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে। তবে আত্মসমর্পণকারীদের অনেকে পুরনো পেশায় ফিরে গেছেন।
সম্প্রতি সুন্দরবনের বয়াসিং এলাকায় ভাসমান বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) চালু করেছে বিজিবি। র্যাব, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের সদস্যদেরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. আশিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে পাঁচটি দস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে। অপহৃত জেলে ও বাওয়ালিদের উদ্ধার ছাড়াও অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়েছে।
বাগেরহাটের সহকারী পুলিশ সুপার (মোংলা সার্কেল) মুশফিকুর রহমান তুষার জানান, ৫ আগস্টের ঘটনার পর দস্যু তৎপরতা বাড়লেও পুলিশ গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। অভিযান চালাতে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে