দেশের রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য জানানো হলে তা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। পরে প্রশাসন সাধারণত দায়সারা বদলির নাটক সাজায়। বিগত কয়েক মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তাকে এমনভাবে বদলি করা হয়েছে।
ছোট অঙ্কের ঘুষ গ্রহণকারীদের শাস্তি দেওয়া হয় তৎপরতার সঙ্গে কিন্তু অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের আয়কর নথি ফাঁস হয়েছে। নথিতে তথ্য গোপন করারও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সেদিকে তেমন নজর নেই। বরং আয়কর রিটার্ন ফাঁসের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে রমনা থানায় সাইবার সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
জানা গেছে, কর অঞ্চল-৪-এর সহকারী কর কমিশনার আতাহার আলী খান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে নথি গায়েব ও ফেসবুক পেজের একটি লিংক সংযুক্ত করা হলেও চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের আয়কর রিটার্ন ফাঁসের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এদিকে, কাতারভিত্তিক আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেছেন, চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান তার ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ করবর্ষের রিটার্নে যে অসত্য তথ্য প্রদান করেছেন, তা তিনি ইতোমধ্যেই ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেছেন। তবে এতে রাষ্ট্রীয় কোনো বিকার প্রকাশিত হয়নি।
চেয়ারম্যানের রিটার্ন প্রকাশিত হলে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তোলপাড় তৈরি হয়। সরকারিভাবে কর অঞ্চল-৪-এ তিনি ওই তিন করবর্ষের রিটার্ন জমা দেন। তবে ওই সময় তিনি এনবিআর চেয়ারম্যান ছিলেন না। ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট সরকার তাকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়। এর আগে জুলকারনাইন সায়ের এনবিআরের সদস্য মোহাম্মদ বেলাল হোসাইনের বিদেশযাত্রার তথ্য গোপন করার বিষয়ে পোস্ট দেন। বেলাল ১৮ সেপ্টেম্বর সরকারি অনুমোদন ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়ার জিও পাওয়ার কথা থাকলেও সিডনিতে গিয়েছেন। ৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাসের টিকিটে তার অস্ট্রেলিয়া যাত্রার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সেই পোস্টে সাংবাদিক আরও উল্লেখ করেন, বেলাল হোসাইন চৌধুরী ক্রিপ্টোকারেন্সিসহ বিদেশে বিভিন্ন সম্পদে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি এনবিআরের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের ক্রিপ্টো বিনিয়োগ চক্রের মূলহোতা হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সরকারী মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অতএব, তার বিষয়ে আরও তদন্ত প্রয়োজন। এরপর এনবিআর পদক্ষেপ নেয়। বেলালকে কাস্টমস, এক্সাইজ ও মূল্য সংযোজন কর আপিল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট করা হয়। এতে জনমনে বিতর্ক তৈরি হয়। ক্রমাগত প্রতিবেদন প্রকাশের চাপের কারণে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
গত ৮ অক্টোবর এনবিআর কাস্টমস যুগ্ম কমিশনারদের বদলির আদেশ জারি করে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমানকে যশোরে বদলি করা হয়। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক শেয়ার বিজ তার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ প্রকাশ করে। অভিযোগে বলা হয়, তিন বছরে তিনি প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কেবল বদলি যথেষ্ট নয়। ঢাকা কাস্টমসের কমিশনার মুহম্মদ জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের আর্থিক অনিয়মের খবর প্রকাশের পরও তাকে বদলি করা হয়।
অপরদিকে, ছোট অঙ্কের দুর্নীতি ধরা পড়লেও বড় কর্মকর্তারা প্রায়ই চোখে পড়ে না। উদাহরণ হিসেবে, ১ সেপ্টেম্বর কর অঞ্চল-৫-এর সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুকে ৩৮ লাখ টাকার ঘুষের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ৭ অক্টোবর ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকার ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তারসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
ছাগলকাণ্ডে ভাইরাল এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের পাহাড়সম অবৈধ সম্পদের তথ্য ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশ হলেও তাকে চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট গ্রেপ্তার হন তিনি ও তার স্ত্রী। এক দশক আগে সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আদালত তার সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আদেশ দিয়েছে।এই সব অনিয়মের বিরুদ্ধে খোদ এনবিআরের কোনো কার্যকর তদন্ত দেখা যায়নি। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন প্রকাশের চাপেই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।
সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, “আমার সময়ে ৯৩ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিলাম। কিন্তু যারা দিয়ে তদন্ত করানো হয়েছিল, তারাও অনিয়মে জড়িত। তারা তদন্ত ঠিকমতো করত না। ফলে তদন্ত শেষ করতে পারিনি।” তিনি আরও বলেন, “এনবিআরের কেউ কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না। যিনি নেবেন, তারও অনিয়ম প্রকাশ হবে। এখানে দুর্নীতিবাজদের একটি চক্র গড়ে উঠেছে। বড়জোর বদলি করা হয়। কিন্তু বদলি কোনো সমাধান নয়।”
অবসরপ্রাপ্ত সচিব বলেন, এনবিআরের অশুভ চক্র ভাঙতে দুই ভাগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে দুর্নীতি ধীরে ধীরে কমবে। ২০২৫ সালের মে মাসে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন নামে দুটি বিভাগ গঠনের অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে। আন্দোলনের একপর্যায়ে চেয়ারম্যান অপসারণের দাবিতে কর্মসূচি হয়। সরকার কঠোর অবস্থান নেওয়ার পর আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এরপর অনেককে চাকরিচ্যুত বা বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।

