পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের এক দশকের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ছিলেন জাহিদ মালেক—প্রথমে প্রতিমন্ত্রী, পরে পূর্ণমন্ত্রী। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের দায়িত্বে। কিন্তু বিদ্রূপ হলো, যে মন্ত্রণালয়ের কাজ মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করা, সেই মন্ত্রণালয়ই তাঁর আমলে অসুস্থ হয়ে পড়ে—দুর্নীতি, লুটপাট ও অদক্ষতার কারণে।
জাহিদ মালেকের সময়ে স্বাস্থ্য খাত হয়ে ওঠে লুটের মেলা। নতুন ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি কেনা, হাসপাতাল অনুমোদন—সব জায়গায় চলেছে কমিশনের রাজত্ব। “চিকিৎসাসেবা” নয়, অন্ধকারে ভাগাভাগির হিসাবই হয়ে উঠেছিল প্রধান এজেন্ডা।
মহামারিতে লুটপাটের মহোৎসব
২০২০ সালের করোনা মহামারি ছিল যেন এই দুর্নীতির সবচেয়ে ভয়ানক সময়। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তখন কিছু হাসপাতালে প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামের দাম একলাফে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এমনকি নিম্নমানের সরঞ্জাম ও অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণের নামে সরকারি অর্থ লুট হয়েছে অজস্র।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে—জাহিদ মালেকের আমলে ৫১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়ম না মেনে সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছে। প্রতিটি কাজ পেতে তাদের দিতে হয়েছে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন। আর এই কমিশনের বড় অংশ যেত সরাসরি সাবেক মন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেক শুভ্রের হাতে।
যন্ত্রপাতি কেনার নামে কোটি টাকার হরিলুট
২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্রয় নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়—মাত্র ২৪টি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে পেয়েছে ৭২টি দরপত্র। মোট লেনদেনের পরিমাণ ৩১৮ কোটি টাকারও বেশি। কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছে মন্ত্রীপুত্র শুভ্র ও অধিদপ্তরের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা—অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন, ডা. নাজমুল ইসলাম এবং টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু।
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিঠু নাম-বেনামে অন্তত ২০টি কোম্পানি খুলে ঠিকাদারি চালিয়ে গেছেন। এমনকি কালো তালিকাভুক্ত থাকার পরও তার আত্মীয়দের প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনার কাজ পেয়েছেন। রিমান্ডে গিয়ে মিঠু নাকি জাহিদ মালেক ও তার পুত্রের নামও বলেছেন—দুদক সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বিদেশ প্রশিক্ষণের নামে নতুন কেলেঙ্কারি
বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে হয়েছে আরেক দফা অর্থ আত্মসাৎ। সরকারি আদেশ অনুযায়ী ৪২৬ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, বাস্তবে এর বড় অংশই ছিল ভুয়া। জনপ্রতি ৪ হাজার ডলার দেখিয়ে প্রশিক্ষণ ব্যয়ের অর্ধেকই বগলদাবা করেছেন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী মহল। এমনকি কিছু অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় তলব করা হলেও জাহিদ মালেক নিজে কখনও ধরা পড়েননি—ফেঁসে যান তাঁর এপিএস আরিফুর রহমান সেখ।
কমিশনের রাজনীতি: চক্রের কেন্দ্রে মন্ত্রীর ছেলে
অধিদপ্তরের ভেতরের কর্মকর্তারা বলছেন, রাহাত মালেক শুভ্রর “অনুমোদন” ছাড়া কোনো ঠিকাদার কাজ পেতেন না। তিনি যাদের পছন্দ করতেন, দরপত্রের শর্তই তৈরি হতো তাদের সুবিধা মতো। সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন ডা. তপন ও ডা. মাজহারুল হক। ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন আদায়, দামের কারসাজি, নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত শুভ্র-তপন চক্র।
নাম বদলে ফিরে আসা কালো তালিকার কোম্পানি
দুদক ও টিআইবি–এর তথ্য বলছে, করোনাকালে কালো তালিকাভুক্ত বহু প্রতিষ্ঠান নাম বদলে আবারও সরকারি কাজ পেয়েছে। যেমন টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মিঠু আত্মীয়দের নামে খুলেছেন ‘ওয়ান ট্রেড’, ‘বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস’, ‘টেকনোওয়ার্থ অ্যাসোসিয়েটস’। এমনকি তাঁর বন্ধু জাহের উদ্দিন সরকারও ‘বেঙ্গল সায়েন্টিফিক’ থেকে নাম বদলে তৈরি করেছেন ‘জেনেসিস ট্রেডিং’ ও ‘এসপি ট্রেডিং হাউস’—সবই কমিশনের জোরে সক্রিয় ছিল।
এই সব প্রতিষ্ঠানের একাধিকটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছেন, কিন্তু ব্যবসা থামেনি। স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা যেন দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল।
অসুস্থ মন্ত্রণালয়ের উপসংহার
এক সময় জনস্বাস্থ্যের আশ্রয়স্থল ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু জাহিদ মালেকের এক দশকে সেই মন্ত্রণালয় নিজেই ভুগেছে দুর্নীতির জ্বরে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নয়, চলেছে বিল-ভাউচার তৈরির প্রতিযোগিতা। কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাঠানো, কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে কাজ দেওয়া, কমিশনের নামে লুটপাট—সবকিছু যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল।
আজ স্বাস্থ্য খাতের ভাঙা ভবন, অচল যন্ত্রপাতি আর নষ্ট বিশ্বাসের দায়টা কার কাঁধে? ইতিহাস হয়তো একদিন উত্তর দেবে—কিন্তু ততদিনে “জনস্বাস্থ্য” নামের এই প্রতিষ্ঠানকে জাহিদ মালেকরা অনেক আগেই আইসিইউতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

