হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় শতাধিক ক্ষুদ্র অনলাইন উদ্যোক্তার কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে কিন্তু এই ট্র্যাজেডিকে কিছু অনলাইন ব্যবসা ‘অর্থের সুযোগ’ হিসেবে ব্যবহার করছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দাবি তুলে তারা ক্রেতাদের পণ্য না দেয়, রিফান্ডে দেরি করে বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে দায় এড়াচ্ছে।
গত সপ্তাহের আগুনে পোশাক, ইলেকট্রনিক পণ্য, কসমেটিকস ও গ্যাজেটসহ নানা ধরনের আমদানি পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে পণ্য আনা অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখন পথে বসেছেন কিন্তু কিছু অনলাইন পেজ এই ট্র্যাজেডিকে ব্যবসায়িক সুযোগ হিসেবে দেখছে। সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো অথেনটিক কেয়ার প্রোডাক্ট বিডি। তারা দাবি করছে, তাদের সব আমদানি পণ্য আগুনে পুড়ে গেছে কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাদের পণ্য প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং আগুনের অজুহাত দেখিয়ে অর্ডার বাতিল করছে বা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে।
পেজটির একজন প্রতিনিধি বলেন, তাদের পণ্য চীন, থাইল্যান্ড ও কোরিয়া থেকে আসে কিন্তু আমদানির বৈধ নথি বা কাস্টমস কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। বরং কথোপকথন বন্ধ করে দিয়েছেন। পরে তারা জানায়, ‘আমাদের কাগজ দিতে হবে না’। অথচ ব্যবসায়িক নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক আমদানিকারকের কাস্টমস ডকুমেন্ট থাকা বাধ্যতামূলক। পেজটির সঙ্গে থাকা কয়েকজন সক্রিয় সদস্য জানিয়েছেন, ‘নায়িকা’ বা ‘ব্র্যান্ড ফেস’রা স্বীকার করেছেন, আগুনে তাদের কোনো পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এরপর তারা তাদের অনলাইন পেজ নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
ক্রেতাদের কাছ থেকেও তথ্য পাওয়া গেছে। আগুনের অজুহাতে অথেনটিক কেয়ার প্রোডাক্ট বিডি এবং অন্যান্য পেজ এখন দ্বিগুণ দামে পণ্য বিক্রি করছে। রাবিয়া আক্তার বলেন, “আগে যেটা ১ হাজার ৮০০ টাকায় কিনতাম, এখন ৩ হাজার ৫০০ টাকা চাই। তবে পরে দেখি অন্য পেজে আগের দামে পাওয়া যাচ্ছে।” সুমা আক্তার বলেন, “তাদের কথায় মনে হয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু আসলে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে। আমাদের টাকা নিয়ে এখন কোনো সাড়া দেয় না।”
প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা বলছেন, মিথ্যা দাবিগুলো তাদের প্রতি সহানুভূতি কমাচ্ছে। উত্তরা এলাকার অনলাইন উদ্যোক্তা নাফিজা ইসলাম বলেন, “আমার পাঁচ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। আমি কাস্টমারদের রিফান্ড দিচ্ছি কিন্তু কিছু পেজ আগুনের গল্প বানিয়ে ব্যবসা করছে, তাই সবাই ভাবছে আমরা মিথ্যা বলছি।”
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রাথমিক যাচাইয়ে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত পণ্য ছিল ইলেকট্রনিক পণ্য, প্রসাধনী, পোশাক ও গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি। যেসব পেজ স্কিন কেয়ার বা কসমেটিকসের কথা বলছে, তাদের নাম তালিকায় নেই। এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, “যাদের পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। কিছু পেজের নাম একেবারেই নেই। অথচ তারা দাবি করছে সব পুড়ে গেছে। এটা স্পষ্ট প্রতারণা।” ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে অথেনটিক কেয়ার প্রোডাক্ট বিডি-সহ কয়েকটি পেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। তারা বলছেন, প্রমাণ পেলে অনলাইন প্রতারণা আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ই-কমার্স বিশ্লেষক মোহিদুল ইসলাম বলেন, “এটা ডিজিটাল ইমোশনাল স্ক্যাম। মানুষ বিপর্যয়ে সহানুভূতিশীল হয়, সেই সুযোগ নিচ্ছে কিছু ব্যবসায়ী। এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণা পুরো মার্কেটের ওপর আস্থা নষ্ট করবে। কার্গো আগুনের ট্রমা এখন ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এটা সামাজিকভাবে ভয়াবহ।” সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে নতুন হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়েছে। শত শত ক্রেতা অভিযোগ করছেন, আগুনের গল্পকে ব্যবসায়িক ফায়দা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতারণা। এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত ও কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি। এতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যাবে। এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “অথেনটিক কেয়ার প্রোডাক্ট বিডি বলেছে, সব পণ্য পুড়ে গেছে। অথচ পরের দিনই লাইভে নতুন অফার দিচ্ছে। এটি শুধু অনৈতিক নয়, দেশের অনলাইন ব্যবসার বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার ওপর সরাসরি আঘাত।

