বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অপেক্ষা করছে, কারণ সরকার আগামী ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ ১৯০ কোটি ডলার এবং আসল ৩৪০ কোটি ডলার পরিশোধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর ফলে ওই অর্থবছরে মোট ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৫৩০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক। যদিও এই পরিমাণ পরবর্তী অর্থবছরে ধীরে ধীরে কমে যাবে, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় সংকেত।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি নথি অনুসারে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের পরিমাণ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে, যার মধ্যে সুদ ১৭০ কোটি এবং আসল ৩৩০ কোটি ডলার। এ ক্ষেত্রে, ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হতে পারে। এই তথ্যগুলো দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ সর্বাধিক হবে, তবে পরের অর্থবছর থেকে তা পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। সরকারের নিয়মিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশী রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায়, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৪৬৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক চাপ লাঘবে সহায়ক হতে পারে।
বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ দীর্ঘকাল ধরে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করছে। প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সময়মতো ঋণের পরিশোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশের বাহ্যিক ঋণের চাপ বাড়ছে, যা ঋণের পরিশোধের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ পর্যালোচনা অনুযায়ী, দেশটি ঋণ সংকটে পড়ার ঝুঁকি কম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দেনা বনাম জিডিপি অনুপাত যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর, যা নির্দেশ করে যে বাহ্যিক উৎস থেকে আরো ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৩৩৬ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসময় ২০০ কোটি ডলার আসল এবং ১৩৪ কোটি ডলার সুদ পরিশোধ করা হয়েছে।
আর্থিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বর্তমান প্রোফাইল অনুযায়ী, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে সবচেয়ে বড় অংকের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, “২০২৬-২৭ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছালেও, পরের অর্থবছর থেকে তা ধীরে ধীরে কমবে।” এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, তিন মাসের রেমিট্যান্সের সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ ওই বছরের সম্পূর্ণ দায় পরিশোধ করতে পারবে।
বাংলাদেশের সরকার ঋণের বোঝা মোকাবেলায় ক্রমাগত পদক্ষেপ নিচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারী থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধার ঘটানোর পর, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন সমস্যার সম্মুখীন করেছে। বিশ্ববাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাহ্যিক চাপ বাড়ছে, ফলে বৈদেশিক অর্থায়নের খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, সরকারের ঋণের অধীনে বাজেট ও প্রকল্প সহায়তা হিসেবে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ প্রয়োজন হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায়, বেশিরভাগ উন্নয়ন অংশীদার ইতোমধ্যে তাদের ঋণের ম্যাচুউরিটি ও গ্রেস পিরিয়ড কমিয়ে অথবা সুদের হার বাড়িয়ে আর্থিক শর্তাবলী সামঞ্জস্য করেছে। এর ফলে রেয়াতি বা সহজ শর্তে বৈদেশিক সহায়তা লাভের সুযোগ কমেছে। তবে কিছু জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগের চাহিদা মেটানোর জন্য দ্বিপাক্ষিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ বেড়েছে।
ইআরডির তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ২৪২.৫৬ শতাংশ বেড়েছে, একইসঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৮৩.৪২ শতাংশ। ২০০৯ সালে সরকার ৮৭ কোটি ৫৫ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল, যা গত ১৫ বছরে বেড়ে ৩৩৫ কোটি ডলারের ওপর পৌঁছেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের প্রায় ৬৮ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে, যা গত অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ডলারে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ ঋণের পরিশোধে স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রেখেছে এবং ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণের চাপ কমানোর জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম। দেশটির ঋণের টেকসই ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এটি একটি ইতিবাচক সংকেত।