মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার করে আর্থিক জালিয়াতির বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে মেশিন লার্নিং-ভিত্তিক এআই প্রযুক্তির সহায়তায় দেশটির অর্থ বিভাগ বিপুল পরিমাণ জালিয়াতি ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। নতুন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ১০০ কোটি ডলারের জালিয়াতি চেক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। সিএনএন-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মার্কিন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা রেনাটা মিসকেল জানিয়েছেন, এআই-এর সহায়তায় এত বড় অঙ্কের জালিয়াতি সনাক্ত করা নিঃসন্দেহে একটি বড় অগ্রগতি। তার মতে, জালিয়াতির ঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ এবং তা দ্রুত ঠেকাতে তথ্যের ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সাল থেকে মার্কিন অর্থ বিভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আসছে। যদিও ব্যাংক ও ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে, সরকারি পর্যায়ে এআই ব্যবহারের কার্যকারিতা এখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালে অর্থ বিভাগ মেশিন লার্নিং-এর মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ জালিয়াতি রোধ করতে পেরেছে তা আগের বছরের তুলনায় ছয়গুণ বেশি।

মিসকেল আরও বলেন, “জালিয়াতকারীরা তথ্য লুকাতে অত্যন্ত দক্ষ কিন্তু এআই সেই গোপন তথ্য সনাক্ত করে তাদের কার্যক্রম ব্যাহত করতে সক্ষম হচ্ছে।” তথ্যের উপর ভিত্তি করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই প্রক্রিয়া জালিয়াতি প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক জালিয়াতির হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সরকারি প্রণোদনার অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে জালিয়াতকারীরা নানা ধরনের কৌশল ব্যবহার করে। সে সময় সরকার বিভিন্ন জরুরি ভিত্তিতে অর্থ সহায়তা প্রদান করছিল, যা জালিয়াতদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল।
মার্কিন অর্থ বিভাগ যদিও এখনো জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করছে না, তবে মেশিন লার্নিং-ভিত্তিক এআই-এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে আর্থিক প্রতারণা ঠেকানোর চেষ্টা করছে। এআই-এর বিপরীতে, জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি যেমন ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি এবং গুগলের জেমিনি সৃজনশীল কাজের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে—ছবি তৈরি, গান লেখা, কিংবা জটিল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে—অর্থ বিভাগ মূলত তথ্য বিশ্লেষণে মনোযোগ দিয়েছে।
মার্কিন অর্থ বিভাগ প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ পরিশোধ করে। সামাজিক নিরাপত্তা, সরকারি কর্মচারীদের বেতন, কর প্রত্যাবর্তনসহ বিভিন্ন খাতে এই অর্থ দেওয়া হয়। এমন বিপুল অঙ্কের লেনদেন স্বাভাবিকভাবেই জালিয়াতকারীদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
২০২৩ সালে ইন্টারন্যাল রেভেনিউ সার্ভিস ঘোষণা দেয়, বড় প্রতিষ্ঠানের জটিল কর রিটার্নগুলো এখন এআই-এর সাহায্যে পরীক্ষা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো এসব রিটার্নের মধ্যে কোনো জালিয়াতি বা ভুলচুক রয়েছে কি না তা সনাক্ত করা।
তবে শুধু প্রতিরোধ নয়, কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে জালিয়াতি করাও শুরু হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে হংকংয়ে একটি ডিপফেক ভিডিওর মাধ্যমে এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীকে আড়াই কোটি ডলার জালিয়াতদের কাছে পাঠাতে প্ররোচিত করা হয়।
মার্কিন অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন এআই ব্যবহারের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে আগেই সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেন, “আর্থিক খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।” নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আর্থিক খাতের জন্য “উদীয়মান দুর্বলতা” হিসেবে দেখছে। জুনিপার রিসার্চের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৮ সালের মধ্যে অনলাইনে আর্থিক জালিয়াতির পরিমাণ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সুতরাং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন আর্থিক খাতের নিরাপত্তা বাড়াচ্ছে, তেমনি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। মার্কিন সরকার এখন এআই-এর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক জালিয়াতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তবে একইসঙ্গে এর সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং এর অপব্যবহার রোধেও সতর্ক থাকতে হচ্ছে। প্রযুক্তির এই দ্বিমুখী প্রভাব আগামীতে আরও বড় পরিসরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।