বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হল প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ উন্নত চিকিৎসার আশায় বিদেশের পথ বেছে নিচ্ছেন, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ চিকিৎসার জন্য বিদেশে ব্যয় করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেশের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার অভাবকে সামনে নিয়ে আসে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য মতে, প্রতিবছর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছে সাত লাখ মানুষ। এতে ব্যয় হয় অন্তত ৩৫০ কোটি ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে চিকিৎসা খাতে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাংলাদেশিদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের পরিমাণ দেখানো আছে ১৭ লাখ ডলার।
বিদেশি চিকিৎসার প্রতিই বাংলাদেশিদের নির্ভরতা
বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের দুর্বলতা বহু বছর ধরেই আলোচনার বিষয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও, উন্নত চিকিৎসার জন্য জনগণের মধ্যে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের সর্বোচ্চসংখ্যক ক্যান্সারে আক্রান্ত যা মোট রোগীর ২১ শতাংশ। এরপর ১৮ শতাংশ হৃদরোগ, ১৩ শতাংশ যাচ্ছে প্রজনন জটিলতার কারণে। আর অন্যদের মধ্যে অর্থোপেডিক, গ্যাস্ট্রোএন্টরোলজি, লিভার, কিডনি, চোখ, কান ও স্নায়বিক চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক পিএইচডি গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় আরো বলা হয়, বাংলাদেশি রোগীদের পছন্দের তালিকায় ভারত শীর্ষে রয়েছে, যা বিদেশে যাওয়া মোট রোগীর ৯২ শতাংশ। এর বাইরে ৮ শতাংশ যাচ্ছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায়। যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অথচ এ অর্থ সহজেই দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ব্যয় করা যেত। চিকিৎসার এই পর্যায়ে দেশের মানুষকে যেমন উচ্চতর চিকিৎসার জন্য গুনতে হচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিও ভুগছে।
কেন বিদেশে চিকিৎসা নিতে এত আগ্রহ?
দেশের অনেক নাগরিক উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন।এর মধ্যে অন্যতম হলো দেশের স্বাস্থ্যসেবার অব্যবস্থাপনা এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। বিশেষত জটিল রোগের ক্ষেত্রে দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগীদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি, এবং দক্ষ ডাক্তারের অভাব লক্ষ্য করা যায়। বিদেশি চিকিৎসা নেওয়ার পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। সেগুলোর হলো-
দেশীয় স্বাস্থ্যসেবার নিম্নমান
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানোর অন্যতম কারণ হলো মানসম্পন্ন সেবার অভাব। উন্নত চিকিৎসার সুযোগ সীমিত এবং সঠিক চিকিৎসা পেতে অনেক সময় রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব এবং চিকিৎসার গুণগত মান নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা নেই। বিশেষ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, এবং জটিল সার্জারির ক্ষেত্রে রোগীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে বাধ্য হন। দেশের চিকিৎসা কেন্দ্রে অনেক সময় রোগীদের সঠিকভাবে সেবা প্রদান করা হয় না। যা রোগীদেরকে চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও বিদেশমুখী করে তোলে। ফলে উন্নত দেশের হাসপাতালগুলোতে মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশায় রোগীরা বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে।
আধুনিক প্রযুক্তির অভাব
বাংলাদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রযুক্তির অভাবও একটি প্রধান কারণ। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রোগীদের উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুর এবং ভারতের মতো দেশে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জটিল রোগের নিরাময় সম্ভব। এ কারণে, এই দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রচুর রোগী যাচ্ছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য।উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালগুলোতে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি রয়েছে, যা বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। যেমন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং হৃদরোগের ক্ষেত্রে উন্নত সার্জারির সুযোগ দেশে সীমিত।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট
দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকা একটি বড় সমস্যা। জটিল রোগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারা রোগীদের বিদেশে যাওয়ার মূল কারণ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভাবে সঠিক সময়ে এবং সঠিক চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হয় না। বিদেশে যাওয়া রোগীদের অনেকে বলেন, দেশীয় চিকিৎসকদের মধ্যে রোগ নির্ণয়ের সঠিক দক্ষতার অভাব রয়েছে, যা তাদেরকে বিদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি নির্ভরশীল করে তুলেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহার এবং চিকিৎসক কর্তৃক রোগীকে অবহেলাও রোগীকে বিদেশমুখী করেছে।
বিদেশমুখীতার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি
প্রতিবছর বিদেশে চিকিৎসার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, তা দেশের জন্য একটি মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতি। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হওয়া এই অর্থ বিদেশে চলে যাওয়ার কারণে দেশের অর্থনীতি একটি বড় চাপের মুখে পড়ে। দেশের অভ্যন্তরে এই অর্থ ব্যবহার করলে দেশীয় স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি সম্ভব হতো, যার মাধ্যমে রোগীরা দেশে থেকেই উন্নতমানের সেবা নিতে পারত।
বিদেশি চিকিৎসার জন্য ডলার ব্যয় হওয়ায় দেশের রিজার্ভে মুদ্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশের মুদ্রা সংকটের সময়ে এই বিপুল অর্থ বিদেশে যাওয়া দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাতে পারে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। এছাড়া বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্রতিনিয়ত অর্থ ব্যয় হওয়া রেমিট্যান্স আয়ের বিপরীতে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে।
দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় বিদেশমুখী রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। তাছাড়া বিনিয়োগকারীদেরও স্বাস্থ্য খাতে লাভের পরিমাণ কিছুটা কম হওয়ায় এ খাতে বিনিয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে না।
এ সংকটে উত্তরণের পথ
বিদেশমুখী চিকিৎসা নির্ভরতা কমাতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার এবং বেসরকারি খাতকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সুফল আশা করা সম্ভব।
যেমন দেশের হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রবর্তন করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করলে রোগীরা দেশেই চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবেন। এছাড়া স্থানীয় চিকিৎসকদের আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশের অভ্যন্তরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সরকারকে চিকিৎসকদের জন্য উচ্চমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে সচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রায়ই দেখা যায়, রোগীদের সাথে সঠিকভাবে আচরণ করা হয় না এবং তাদের নির্ভুল চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে দেশের নাগরিকরা স্থানীয় চিকিৎসার উপর আস্থা রাখতে পারেন।
তাছাড়া বাংলাদেশে এখনও সবার জন্য সুলভ এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। তাই, সরকারকে স্বাস্থ্যবীমা পরিকল্পনা আরও উন্নত করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই চিকিৎসা পেতে পারে এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন না হয়।
দেশীয় হাসপাতালগুলোতে সেবার মান বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে রোগীদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এর মাধ্যমে তারা বুঝতে পারবেন যে দেশের হাসপাতালগুলোতেও উন্নত চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব এবং বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
অবশেষে বলা যায়, বিদেশমুখীতার ফলে চিকিৎসা খাতে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতি শুধু দেশের মুদ্রার উপরই প্রভাব ফেলছে না, বরং দেশীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সরকারের কার্যকর নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। জনগণের জন্য গুণগতমানের সেবা এবং সুলভ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে বিদেশে চিকিৎসার উপর নির্ভরতা অনেকাংশেই কমে আসবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি দেশের মানুষকেও আর বিদেশি চিকিৎসার জন্য ডলার ব্যয় করতে হবে না। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নও সম্ভব হবে, যা দেশের জনগণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ বয়ে আনবে।